ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিরোধপূর্ণ ফেনীর পরশুরামে মুহুরীর চরে সীমানা নির্ধারণের সাত বছর পার হলেও নিজেদের জমিতে যেতে পারছে না বাংলাদেশীরা। বিরোধপূর্ণ ওই জমিতে দু-দেশের যৌথ জরিপ দল সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। জরিপ দল কাঠের পিলার স্থাপন করে দিলেও ভারতের পক্ষ থেকে স্থায়ী পিলার নির্মাণের সম্মতির অভাবে সমস্যার সমাধান ঝুলে আছে। এই সুযোগে চোরাকারবারি ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিরাপদ পয়েন্ট হিসেবে ওই এলাকাটির ব্যবহার বাড়ছে বলে জানা গেছে। মুহুরীর চর এলাকায় বিলোনিয়া স্থলবন্দর হওয়ায় মাদকপাচারসহ বিভিন্ন সীমান্ত অপরাধের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে দুই দেশ। ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর বিরোধপূর্ণ মুহুরী চর সরেজমিন দেখতে এসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক তৎকালীন উপদেষ্টা গওহর রিজভীসহ বিগত কয়েক বছরে সরকারের সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মুহুরীরচর পরিদর্শন করে গেছেন একাধিকবার।
বন্ধুপ্রতীম ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে ঝুঁলে থাকা মুহুরীর চরের বিরোধ মীমাংসা ও সীমানা নির্ধারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়েও আলোচনা হয়েছিল।
২০১৭ সালের ১৫ জুলাই বিলোনিয়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মহাপরিচালক বাংলাদেশে এসে সীমান্ত হত্যা বন্ধ, পরশুরাম সীমান্তে ঝুলে থাকা মুহুরীরচর সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।
জানা গেছে, মুহুরী নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বাংলাদেশীরা তাদের জমিতে ফসল ফলানো ও চাষাবাদ করা নিয়ে অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে সমস্যায় রয়েছে। দুই দেশের স্বার্থে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা ও সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তিস্তা নিয়ে আলোচনা আর ছিটমহল বিনিময় চুক্তি করার পর থেকে মুহুরীর চরের জমি ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আশায় বুক বাঁধে বাংলাদেশীরা। কিন্তু দুই দেশের যৌথ জরিপ দলের নির্ধারণ করে দেয়া সীমানায় স্থায়ী পিলার স্থাপনে ভারতের অনীহার কারণেই মূলত ঝুলে রয়েছে মুহুরীর চর বিরোধ। সীমানা নির্ধারণ হলেও নিজেদের জমিতে এখনো যেতে পারছেন না বাংলাদেশীরা।
জানা গেছে, মুহুরীর চর দখলে রাখতে ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৯ সালের ২২ আগস্ট পর্যন্ত ৫৮ দিন ভারতীয় বিএসএফ ও বিজিবির(বিডিআর) গুলি বিনিময় হয়েছে। ১৯৯৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশের বাউর পাথর গ্রামের বেয়াধন বিবি (৪০)। চরে নিজেদের জমির অধিকার ফিরে পেতে এ পর্যন্ত শতাধিক বাংলাদেশী আহত হয়েছেন বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকদের হাতে। দীর্ঘ দিনের বিরোধপূর্ণ মুহুরীর চরের ২.৫ কিমি. সীমান্ত এলাকা চিহ্নিত করা যায়নি। ২০১১ সালে বাংলাদেশ জরিপ অধিদফতর এ সীমানা চিহ্নিত করতে জরিপ পরিচালনা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে উভয় দেশের জরিপ বিভাগ মুহুরীর চরে জরিপ পরিচালনা করে। মহাপরিচালক পর্যায়ে দুই দেশের জরিপ শেষে সীমানা নির্ধারণ করে কাঠের পিলার স্থাপন করে। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক তৎকালীন উপদেষ্টা গওহর রিজভী মুহুরীর চর সফরে এসে বলেছিলেন, ভারতের সংসদে অনুমোদনের পর পাকা সীমানা পিলার নির্মাণ করা হলে মুহুরীর চরের দীর্ঘদিনের বিরোধ নিষ্পত্তি হবে।
বাংলাদেশের পক্ষ যৌথ জরিপ দলের স্থাপন করা অস্থায়ী পিলারের স্থলে স্থায়ী পিলার স্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হলেও ভারতের সাড়া মিলছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছিল। ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের সার্বভৌম অঞ্চল মুহুরীর চরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ভারত দখলে নিয়েছে। উন্নততর প্রকৌশল প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মুহুরী নদীতে স্পার ও গ্রোয়েন নির্মাণের মাধ্যমে নদীর গতিধারাকে ভারত ক্রমান্বয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশের ভূ-অভ্যন্তরে সু-কৌশলে বিলোনিয়ার পাশে নিজ কালিকাপুর গ্রামের মুহুরী নদীর বাকে চরের অংশটি মূল চরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ কারণে ক্রমাগত উত্তর অংশে (ভারত) চরের সৃষ্টি হয়ে নদী মোহনা বাংলাদেশের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে। দুই দেশের সীমানা হিসেবে মুহুরী নদীর মধ্য স্রোতকে নির্ধারণ করা হয়।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) আবারো মধ্য স্রোতকে উভয় দেশের সীমানা হিসেবে নির্ধারণ করে। এরপর ১৯৭৬ সালে ভারত নিজ অঞ্চলের সীমান্ত শহরে বিলোনিয়াকে নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষার কথা বলে প্রথমে বাংলাদেশ সীমান্তের কয়েক শ’ মিটার উজানে গ্রোয়েন নির্মাণ করে। আর তখন থেকে মুহুরী নদীর গতিপথ পূর্ব থেকে পশ্চিমে মোড় নিতে শুরু করে। পরশুরামের নিজ কালিকাপুর সীমান্তের ২১৫৯ পিলার থেকে স্থলবন্দরস্থ ২১৬০ পিলার পর্যন্ত মাঝখানে প্রায় ৪৭টি সাবপিলার নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় প্রায় ৯২ একর সম্পত্তি বিরোধপূর্ণ মুহুরীর চর হিসেবে অবস্থিত বলে জানা গেছে। মুহুরীর চরে জমি হারানো স্থানীয় বাংলাদেশীরা তাদের জমিতে ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। গত শনিবার বিরোধপূর্ণ মুহুরীর চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুই দেশের জরিপ দলের নির্ধারিত সীমানায় কাঠের পিলার রয়েছে। তবে দুই অংশেই চাষাবাদ হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে গতকাল রোববার বিকেলে পরশুরাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মজুমদার জানান, তারা মুহুরী চরের জমির ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে চান, যাতে বাংলাদেশীরা তাদের জমিতে চাষাবাদ শুরু করতে পারেন।
বিজিবির ৪ ফেনী ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল কামরুজ্জামান জানান, দুই দেশের জরিপ দলের নির্ধারিত সীমানায় সীমান্তে কাঠের পিলার রয়েছে, আমরা জেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রাখছি, চাষাবাদের সিদ্ধান্ত হয়নি।
ফেনী ট্রিবিউন/এএএম/এপি