ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ডিগ্রি মাদ্রাসায় দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে নির্মমভাবে নিহত আলিম পরীক্ষার্থী ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি একটি আলোচিত নাম। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার যৌন লালসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে সিরাজের নির্দেশে তার লালিত ছাত্র নামধারী ক্যাডারদের হাতে দেশবাসীকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন নুসরাত। আর সেই মাদ্রার দশম শ্রেনির ছাত্র রাশেদুল হাসান রায়হান।
বোনের দু:সহ স্মৃতির বেদনা নিয়ে বেঁচে আসে সে। ঘুমহীন ক্লান্ত দেহ নিয়ে হাজারো মানুষের ভিড়ে একটু প্রশান্তি খুজেন তিনি। বোনের হত্যাককারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবী জানান রায়হান।
মাদ্রাসাটি কলঙ্কিত মাদ্রাসা আখ্যা দিয়ে জানান, কিভাবে ওই মাদ্রাসায় পড়বো? কি জবাব দেবো সহপাঠি ও শিক্ষকদের? কিভাবে ভুলবো আমার আপুর অসহ্য যন্ত্রণার কথা? আমি আর ওই মাদ্রাসায় পড়বোনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতের সময় তিনি বলেছিলেন দাখিল পরীক্ষার তার পড়ালেখার দায়ীত্ব নেবেন তিনি। দাখিল পাস করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে জানাবো তিনি সহযোগিতা করলে আমি উন্নত দেশে পড়ালেখা করতে চাই। আমার বোনের স্মৃতি যেন হারিয়ে না যায়। আমি আশা করছি দেশবাসীর সহযোগিতায় আমার বোনের প্রতিবাদের এই দৃষ্টান্ত কখনো হেরে যেতে পারবেনা।
নুসরাতের স্বপ্ন ছিল আলিম পাস করে ফেনীর আরেকটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করবেন। ওই মাদ্রাসায় ফাজিল শ্রেনি থাকলেও মাকে জানিয়েে রেখেছিল অধ্যক্ষ সিরাজের কুদৃষ্টির কথা। মাকে বলে রেখেছিল মা আমি আলিম পাস করার পর ওই মাদ্রাসায় ফাজিলে আর ভর্তি হবোনা। ফেনীর অন্য যে কোন মাদ্রাসায় ফাজিলে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন রাফি। রাফি দাখিল পাস করেছিল বাড়ির পাশের খাদিজাতুল কোবরা মহিলা মাদ্রাসা থেকে। দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিল সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসা পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বখাটেদের চুন সন্ত্রাসের শিকারও হয়েছিল সে।
অন্ধত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে দৃঢ মনোবল নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে সফলতার সাথে দাখিল পাস সে। আলিমে ভর্তি হওয়ার এক বছর পর থেকে কুদৃষ্টি পড়ে সিরাজের। নানা কৌশলে কুপ্রস্তাব দিত রাফিকে। রাফি তার মাকে বিষয় গুলো খুলে বললে মা তাকে অধ্যক্ষের কক্ষে কখনো একা যেতে নিষেধ করেন তাকে। সে মোতাবেক রাফি কখনো অধ্যক্ষের কক্ষে একা যেতেননা। গত ২৭ মার্চও দপ্তরী নূরুল আমিনকে দিয়ে রাফিকে তার কক্ষে ডেকে আনেন। রাফি কিন্তু তার অপর তিনজন বান্ধবীকে নিয়ে অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করে। তখন লম্পট সিরাজ রাফির অপর বান্ধবীদের বাইরে যেতে বলে রাফিকে একা রেখে দেন। প্রথমে রাফিকে পরীক্ষার আধা ঘন্টা পূর্বে প্রশ্নপত্র দেয়ার লোভ দেখিয়ে কুপ্রস্তাব দেয়। তাতে রাফি রাজি না হলে তাকে বলে তুইতো এবার কলঙ্কিত হয়েছিস তোর কথা কেউ আর বিশ্বাস করবেনা। তুইতো অন্য ছেলের সাথে প্রেম করিস আমার সাথে প্রেম করতে সমস্যা কোথায়। তখন রাফি তাকে উত্তর দিয়েছিল আপনীতো আমার ওস্তাদ তাছাড়া পিতার মতো লোক। এই ফাঁকে রাফির উপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে অধ্যক্ষ সিরাজ। নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে পিতার বয়সী অধ্যক্ষের সাথে ধস্তাধস্তি করতে হয়ছে রাফিকে। এক পর্যায়ে রাফি অজ্ঞান হয়ে পড়লে রাফির মাকে টেলিফোনে রাফি হঠাৎ অসুস্থতার খবর জানান অধ্যক্ষ। এর মাঝে ফাঁকে রাফির চোখে পানি ছিটালে জ্ঞান ফিরলে জড়োসড় হয়ে অধ্যক্ষের চেয়ারের নীচে বসে পড়েন। তখন কলিং বেইল টিপে দপ্তরী নূরুল আমিনকে ডাকেন অধ্যক্ষ। নূরুল আমিন এসে তোর কি সমস্যা, কি হয়েছে বলতেই রাফি অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে দৌড়ে বের হয়ে ওই ভবনের তৃতীয় তলার শ্রেনি কক্ষে চলে যায়। সেখানে গিয়ে টেবিলের উপর মাথা রেখে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। এরপর তার কক্ষে প্রবেশ করে রাফির দুই বান্ধবী।
এর মাঝে একজন ছাত্র এসে অধ্যক্ষকে জানান, একজন ছাত্রী শ্রেনি কক্ষে অঝর ধারায় কান্না করছে। অধ্যক্ষ একটি বেত নিয়ে ওই শ্রেনি কক্ষে গিয়ে নুসরাতকে কি যেন বলে আসে। তখন নুসরাত শ্রেনি কক্ষ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে বাড়িতে চলে যায়। বাড়িতে গিয়ে মাকে অধ্যক্ষের লালসার কথা জানালে তার মা তাৎক্ষণিক রাফিকে নিয়ে এলাকার তিনজন পৌর কাউন্সিলর সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে মাদ্রাসায় প্রবেশ করেন। এসময় রাফির দুই ভাই এলাকার লোকজন অধ্যক্ষকে মারধর করতে উদ্যত হয়। অধ্যক্ষ তার কক্ষে হাফ ছেড়ে সোফার উপর বেসামাল হয়ে বসে থাকেন। তার মা উত্তেজিত কন্ঠে জানতে চান রাফির সাথে তার কি হয়েছে? কেন সে রাফির সর্বনাশ করতে চেয়েছিল? তখন অধ্যক্ষ রাফির মাকে আশালীণ ভাষায় গালি দিয়ে পরীক্ষায় পাস কিভাবে করে দেখিয়ে দেবো বলো হুঙ্কার দেন। এসময় রাফির মা আর স্থির থাকতে পারেননি। টেবিলের উপর রাখা বেতনিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজকে ৪টি বেত্রাঘাত করেন।
এরপর সিরাজ তার মুঠোফোন দিয়ে উপজেলা আ’লীগের সভাপতি রুহুল আমিন ও পৌর কাউন্সিলর মোকসুদ আলমকে ফোন। কিছুক্ষণ পর রুহুল আমিন ঘটনাস্থলে এসে বিষয়টি জানতে পেরে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে পুলিশ পাঠাতে বলেন। এসময় মাদ্রাসার শ্রেনি কার্যক্রম চলা অবস্থায় থমথমে পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কয়েকটি শ্রেনি কক্ষের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে এসআই ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে আসেন। এসময় এসআই ইকবালও ওই ছাত্রীকে ধমক দিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বিষয়টি তাৎক্ষণিক সমাধান না হওয়ায় এসআই ইকবাল হোসেন অধ্যক্ষ ও নুসরাত কে থানায় নিয়ে যান। সেখানে নিলে ওসি তার কক্ষে নুসরাতের বক্তব্য রেকডিং করেন। পরবর্তীতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অধ্যক্ষ সিরাজকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
পরদিন ২৮মার্চ সকালে অধ্যক্ষকে কারাগারে পাঠানোর প্রাক্কালে নুসরাতের এলাকার লোকজন নিয়ে অধ্যক্ষের শাস্তি দাবীতে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করা হয়। তাৎক্ষণিক অপর পৌর কাউন্সিলর মোকসুদ আলমের নেতৃত্বে মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে পাল্টা মানববন্ধন ও মিছিল করতে গিয়ে দুই পৌর কাউন্সিলরের মাঝে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে সোনাগাজী বালিকাপাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অধ্যক্ষের শাস্তি দাবীতে মানববন্ধন করে। পরদিন পূণরায় মাদ্রাসার প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের মুক্তির দাবীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে। এরপর তারা ইউএনও, এডিএম ও জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেয়। ৩ এপ্রিল তারা কারাবন্দি অধ্যক্ষ সিরাজের সাথে দেখা করতে গেলে সিরাজ তার জন্য কি করেছে এমন প্রশ্ন করে ছাত্রদের। এক পর্যায়ে নূর উদ্দিন ও শামীমকে নির্দেশ দেয় পুড়িয়ে হত্যার। সিরাজের নির্দেশ মোতাবেক তারা ৪এ্রপ্রিল ও ৫এপ্রিল মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদেরের কক্ষে দফায় দফায় বৈঠক করে রাফিকে হত্যার চক আঁকে এবং পরিকল্পনা করে।
পরবর্তীতে গত ৬এপ্রিল পরিকল্পিতভাবে পরীক্ষার হল থেকে সিরাজের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপির মাধ্যমে নুসরাতের বান্ধবী নিষাদকে মারছে বলে ডেকে নিয়ে শেল্টার হাউজের তৃতীয় তলায় নিয়ে প্রথমে মামলা নিতে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলেন। রাফি রাজি না হলে মুখ চেপে ধরে হাত পা বেধে জোবায়ের দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিলিং মিশনে অংশ নেয় শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মেল সুলতানা পাপি, কামরুননাহার মণি, জোবায়ের হোসেন। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের প্লাস্টিক এন্ড সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০এ্রপিল রাত সাড়ে নয়টার দিকে দেশবাসীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যায়। ৮এপ্রিল নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হোসেন নোমান বাদী হয়ে ৮জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন। ১০এপ্রিল আদালত মামলাটিকে তদন্তের জন্য পিবিআয়ের নিকট হস্তান্তর করে। পিবিআই এজাহারভুক্ত ৮ আসামি সহ ২০জনকে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জন আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। নুসরাতের মা, ভাই, শিক্ষার্থী দপ্তরী, পুলিশ পিবিআই সহ সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে এসব তথ্য জানা গেছে।
সম্পাদনা : এএএম/এটি