ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যা মামলায় ১৬ জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও বাদীপক্ষের খণ্ডন শেষে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এ রায় দেন।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে তাকে যৌন হয়রানি করেন। এ ঘটনায় রাফির মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেয়া হয়।
পরে চলতি বছরের ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিতে ওই মাদরাসার কেন্দ্রে যায় রাফি। এ সময় বোরকা পরিহিত কয়েকজন তাকে পাশের বহুতল ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। রাজি না হলে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয় তারা। এতে নুসরাতের পুরো শরীর দগ্ধ হয়ে যায়।
১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুসরাত। মৃত্যুর পর ১১ এপ্রিল তার মরদেহ আনা হয় নিজ বাড়িতে। সোনাগাজী সাবের পাইলট হাইস্কুল মাঠে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। রাফি হত্যা মামলায় পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাসহ ২১ জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করে। পরে ২৯ মে ১৬ জনকে আসামি করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই।
মামলায় পুলিশের অবহেলার অভিযোগে ১৩ মে প্রত্যাহার করা হয় ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে। থানায় হেনস্থা হওয়া নুসরাতের ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার পর ৮ মে সোনাগাজী থানার ওসি মেয়াজ্জেমসহ পুলিশের দুই এসআই-কে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ১৬ জুন তাকে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
পরে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ আনা হয়। এগুলো হলো- ১. মামলার কালক্ষেপণ, ২. এজহার নিয়ে কূটচাল, ৩. গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের নাম বাদ, ৪. নুসরাতকে থানায় জবানবন্দির নামে ওসির হেনস্থা, ৫. আইনি বহির্ভূত জিজ্ঞাসাবাদ, ৬. প্রথমে অজ্ঞাত মামলা, পরে ৮ জনের নামোল্লেখ।
অভিযোগপত্র গ্রহণ, চার্জ গঠন ও বিচার
পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে আসে ছাদে কিলিং মিশনে অংশ নেয় ৫ জন। কারাগার থেকেই নুসরাতকে হত্যার নির্দেশ দেন মাদরাসার অধ্যক্ষ্য সিরাজ উদদৌলা। গেট ও সিঁড়ি পাহারায় ছিল বাকি আসামিরা।
কিলিং মিশনে যে পাঁচজন অংশ নিয়েছিল-
১. শাহাদাত হোসেন শামীম
২. জাবেদ হোসেন
৩. জোবায়ের আহম্মদ
৪. উম্মে সুলতানা পপি
৫. কামরুন নাহার মনি।
এ বছরের ১০ জুন অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। এরপর ২০ জুন চার্জ গঠন হয়। ২৭ জুন থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়, ৯০ জন সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দেন মোট ৮৭ জন। দীর্ঘ ৪৭ দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল যুক্তিতর্ক। চলে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবরকে নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক গ্রহণ করা হয়।
মামলার এজাহারে আসামিদের তালিকা ও রিমান্ডসহ অন্যান্য তথ্য (তাদের সবাই গ্রেফতার হয়েছেন)-
১. এস এম সিরাজ উদদৌলা, অধ্যক্ষ রিমান্ড-৭ দিন-আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দি।
২ আফসার উদ্দিন, প্রভাষক- রিমান্ড-৫ দিন।
৩.জোবায়ের আহম্মেদ- রিমান্ড-৫ দিন-১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি।
৪. মাকসুদ আলম, কাউন্সিলর, রিমান্ড-৫ দিন।
৫. জাবেদ হোসেন- রিমান্ড-৭ দিন, দ্বিতীয় দফা ৩ দিন। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি।
৬. নুর উদ্দিন- ১৬৪ ধারা জবানবন্দি।
৭. শাহাদাত হোসেন শামীম- ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি, ২৫ এপ্রিল ৩ দিনের রিমান্ড।
৮. হাফেজ আবদুল কাদের- ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি।
৯. আরিফুল ইসলাম- রিমান্ড-৫ দিন।
১০. সাইদুল ইসলাম- রিমান্ড-৫ দিন।
১১. কেফায়েত উল্লাহ- রিমান্ড-৫ দিন।
১২. নুর হোসেন- রিমান্ড-৫ দিন।
১৩. আলা উদ্দিন- রিমান্ড-৫ দিন।
১৪. উম্মে সুলতানা পপি- রিমান্ড-৫ দিন।
১৫. মো. শামীম-১৫ এপ্রিল গ্রেফতার- ১৮ তারিখ শুনানি।
১৬. কামরুন নাহার মনি-১৫ এপ্রিল গ্রেফতার, ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর।
১৭. আবদুর রহীম শরিফ- ১৭ এপ্রিল গ্রেফতার এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি।
১৮. রহুল আমিন, সভাপতি, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ। গ্রেফতার ২০ এপ্রিল, রিমান্ড-৫ দিন।
১৯. এমরান হোসেন মামুন সরাসরি কারাগারে।
২০. ইফতেখার উদ্দিন রানা। সরাসরি কারাগারে।
২১. মহিউদ্দিন শাকিল, গ্রেফতার ২৫ এপ্রিল, ফেনীর উকিলপাড়া থেকে।
আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে যারা-
১. নুর উদ্দিন- (এজহারনামীয়)।
২. শাহাদাত হোসেন শামীম- (এজহারনামীয়)।
৩.আবদুর রহিম শরিফ-(এজহারনামীয়)।
৪. হাফেজ আবদুল কাদের-(এজহারনামীয়)।
৫. উম্মে সুলতানা পপি- (সন্দিগ্ধ)।
৬. জাবেদ হোসেন- (এজহারনামীয়)।
৭. কামরুন নাহার মনি (সন্দিগ্ধ)।
৮. জোবায়ের আহম্মেদ (এজহারনামীয়)।
৯. অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা। (এজহারনামীয়)।
১০. এমরান হোসেন মামুন।
১১. ইফতেখার উদ্দিন রানা।
১২. মহিউদ্দিন শাকিল, গ্রেফতার ২৫ এপ্রিল, ফেনীর উকিলপাড়া থেকে।
১৬৪ ধারা জবানবন্দি দেননি যারা-
সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম ও আবছার উদ্দিন, রুহুল আমিন, মোহাম্মদ শামীম।
এ মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬ আসামি হলেন-
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা (৫৭), রুহুল আমিন (৫৫), সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম (৫০), মাদ্রাসার শিক্ষক আবদুল কাদের (২৫), প্রভাষক আফসার উদ্দিন (৩৩), মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ যোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ (১৯), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন (১৯), আবদুর রহিম শরিফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), মোহাম্মদ শামীম (২০) ও মহি উদ্দিন শাকিল (২০)।
এদের প্রত্যেককেই এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
ফেনী ট্রিবিউন/টিএএস/টিআরএইচ