অনন্তকাল ¯্রােতের মধ্যে বুদবুদের মতো মানুষের জীবন, অবিরত ফুটছে আর ঝরছে । দুনিয়ার খেলাঘরে কয়টি মুহূর্ত কাটিয়ে দেওয়ার জন্য কি তার আয়োজন ? আর নিজের শক্তির পরিচয়ে কি তার আনন্দ ? মানুষ পৃথিবীতে কুচুরি পানার মতো ভেসে আসে, আবার ভেসে চলে যায়, এর মাঝে কিছু মানুষের জীবন দর্শন সততা , ত্যাগ, অন্যদের জন্য প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকে। ফেনীর দাগনভুইয়া উপজেলার বেকের বাজারের ডাক্তার কাজী আহসান উল্লাহ ছিলেন এমন একটি সাদা মনের মানুষ। যিনি আজিবন মানব সেবা, শিক্ষার প্রসার সতভাবে জীবন যাপন করে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি আমার বাল্যকালের শিক্ষক ছিলেন বলে খুব কাছ থেকে তাকে দেখেছি। তার জীবন থেকে কিছু স্মৃতি নিয়ে আজকের এই অবতারণা।
ডাক্তার কাজি আহসান উল্লাহ ১৯৫৬ সালের পহেলা নভেম্বর উত্তর নেয়াজপুর খলিল সওদাগর বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদার নাম আবদুল আজিজ। তার পিতা সালামত উল্লাহ তিনি তৎকালীন বৃটিশ টোবাকো কোম্পানীতে চাকুরী সুবাধে তার মা সহ কলিকাতার বসবাস করতেন। পরবতী ১৯৬০ সালে বেকের বাজারে আশ্রাফপুরে এসে নতুন বাড়ি স্থাপন করেন। ১৯৬৮ সালের দাখিল পরীক্ষায় সিলোনিয়া মাদ্রাসার থেকে র্বোড সর্বচ্চ নাম্বার পেয়ে কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীণ হন। পরর্বতীতে লক্ষীগঞ্জ নাজেরিয়া ফাযিল মাদ্রাস থেকে আলিম এবং ফেণী আলীয়া মাদ্রাসা থেকে ফাযিল এবং সেই সাথে ফেনী সরকারী কলেজ থেকে ডিগ্রি সমাপ্ত করে।
পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি তৎকালীন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা নুর মোহাম্মদ আ’জমী সাহেব (রঃ)এর সান্নীদ্যে থেকে শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি দর্শন কোরআন হাদিস ইজমা কিয়াস ও তাত্ত্বিক জ্ঞান লাভ করেন। ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র দৈনিক পত্রিকা দৈনিক আজাদ ডাঃ আহছান উল্যাহর মাধ্যমে থেকে নুর মোহাম্মদ আ’জমী সাহেব নিকট আসত। পরবতীতে সেই সুবাধে সেকালের বিশিষ্ট লোক ডাঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সহ অনেক খ্যাতিমান গণীজদের সাথে কাজী আহছান উল্যাহ সর্ম্পক স্থাপিত হয়।
সেকালের বিশিষ্ট লেখক ডঃ মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ, পল্লিকবি জসিম উদ্দিন, ৫ খানা বইয়ের লেখক মাওলানা নুর মোহাম্মাদ আজমি সহ অনেক
খ্যতিমান গুণীজনের সাথে ডাক্তার কাজী আহসান উল্লাহর গভির সম্পর্ক ছিল। আমাদের আশ্রাফপুর গ্রামের এই প্রতিভাবান ব্যাক্তি এবং সাদা মনের মানুষ এবং সকলের প্রিয়ভাজন কাজী আহসান পরপকারি এবং ত্যাগি ব্যক্তি সৎ পরহেজগার হিসাবে সকলের কাছে ছিলেন প্রিয়। সেই সময় আমাদের গ্রামে চিকিৎসার তেমন কোন বালাই না থাকায় তিনি ১৯৭৪ সালে ডাক্তারী ট্রেনিং সমাপ্ত করে স্থানীয় বেকের বাজারে ফামের্সী দিয়ে মানব সেবায় আতœ নিয়োগ করেন।
তিনি ছোট বেলায় আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। ঔষধের পাশাপাশি তিনি আমাদের বিভিন্ন দোয়া শেখাতেন। সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা কারী কাজী আহসান কাকার মতো এমন সাদা মনের মানুষ , অনন্য ব্যাক্তি এখন গ্রামে চোখে পড়েনা। কিন্তু জিবনে কখনো মিথ্যার আশ্রয় ,ধোঁকাবাজি করে অর্থ সম্পদ অর্জন করতে তাকে কেউ কোনদিন দেখেনি। ১৯৯০ সালে তিনি সরকারের আইন মন্ত্রনালয় থেকে ৬নং দাগনভূঞা ও ৭নং মাতুভূঞা ইউনিয়নের ম্যারিজ রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং পরবতীতে ৮নং জায়লস্কর ইউনিয়নের অতিরিক্ত দায়িত্ব সহ ৩টি ইউনিয়নের ম্যারিজ রেজিস্ট্রার হিসেবে সততা নিষ্ঠাও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
তার দায়িত্ব পালন কালীন সময়ে তিনি অসহায় ও দুস্থ্য মানুষদের যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগীতা করতেন র্মমে এলাকার সুনাম রয়েছে। অনেক গরীব মানুষের বিয়ের রেজিস্ট্রার ফিস না নিয়ে সহযোগীতা করতেন। আমার সাথে বিভিন্ন জীবন দর্শন নিয়ে, সংস্কৃতি,এবং রাজনিতি নিয়ে অনেক গল্প হতো।একবার তিনি অসুস্থ লেখক ও আলেম নুর মোহাম্মাদ আজমিকে ঢাকা পিজি হাসপাতালে দেখতে যান। যাবার সময় গ্রাম থেকে কিছু পিঠা,পায়েস,চিড়া এসব নিয়ে যান। লেখক আজমি সাহেব তাকে পাঠান আরেক রোগী ডঃ মোহাম্মাদ শহিদুল্লাহর কেবিনে। ডঃ শহিদুল্লাহ বলেন, আহসান, আজমি সাহেব খেয়ে কিছু বাচলে আমাকে দিও। আগে নুর মোহাম্মাদ আজমি সাহেবের খেয়াল রাখো। তিনি বেশি অসুস্থ। আসলে বাংলাদেশের এই দুই প্রতিভাবান ব্যাক্তি তখন অসুস্থ।
তার দোকানের রাখা খবরের কাগজ পড়তে আমরা ছোট বেলায় বিকেলে জমা হতাম। রাক্ষুসের ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম, কখন কাজী আহসান উল্লাহর ডিসপেনসারি খুলবে , কার আগে কে পড়বো খবরের কাগজ। জীবনের অনেক সল্পতার মধ্যে কাজি আহসান উল্লাহ দুইটি প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র চালু করেছিলেন। সরকারি সহায়তা না পেয়ে কয়েক বছরের মধ্যে নুর মোহাম্মাদ আজমি প্রাথমিক এবং ডমুরুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের সামনে এই দুটি শিক্ষা প্রাতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য কাজি আহসান আপ্রাণ চেষ্টা চালান। গ্রামে শিক্ষার অভাব দেখে কাজি আহসান এখানে শিক্ষার প্রদীপ জালাতে চেয়ে ছিলেন। সেকালে মকবুল আহমেদ হাই স্কুল, আমিন উল্লাহ ইসলামিয়া মাদ্ররাসা, সানরাইজ ইনস্টিটিউট কিংবা জমিরয়া ইসলামিয়া মাদ্ররাসা কিছুই ছিলোনা। তিনি বেকের বাজার জামে মসজিদের প্রায় ৩০ বছর যাবত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সেই সাথে এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব পালন করেন।
গ্রামীণ জনগনের সাস্থ্য সেবা, মা ও শিশু সেবা, পলিও টিকাদান ইত্যাদি সরকারি ও বেসরকারি সেবা সংস্থার সাথে ডাক্তার কাজি আহসান উল্লাহর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড বিশেষ করে বিচার শালিসের মাধ্যমে মানুষের সমস্যা সমাধানে তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করতেন। তিনি ১৯৮৪ সালে গ্রাম সরকার নির্বাচন হন এবং সুনামে সাথে সেই দায়িত্ব পালন করে ছিলেন।
তিনি বেশি বেশি পান খেতেন এবং প্রাণ উজাড় করে হাসঁতেন। যখন গ্রামে কোন শিক্ষিত লোক ছিলোনা, অনেকেই তার কাছে আসতেন প্রবাসে পত্র লেখাতে। তিনি হাসি মুখে লোকজনের চিঠি লিখে দিতেন। এমন সাদা মনের মানুষ ২০১২ সালের ২০ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। গ্রামে এখন সাদা মনের মানুষের দারুণ অভাব।
লেখক: প্রবাসী লেখক ও কলামিস্ট