করোনাভাইরাসের কারণে দু’মাস ধরে বন্ধ শুটিং। প্রায় স্তব্ধ বিনোদন দুনিয়া। প্রত্যেক দিন সন্ধ্যা হলেই চা আর টিভির রিমোট নিয়ে বসে পড়ত যে বাঙালি, তার সম্বল এখন রিপিট টেলিকাস্ট, ডাবড শো কিংবা বাড়ি থেকে মুঠোফোনে শুট করা কিছু কনটেন্ট। তবে সময় তো আর সবসময় এক যায়না। আবারো বাঙালি ফিরবে তার চিরচেনা রূপে। পৃথিবীর হাসির সঙ্গে হেসে উঠবে মানুষগুলোও।
আবারো শুরু হবে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যস্ততা। শুটিং ফ্লোরে লাইট ক্যামেরার ঝলাকানি আর নতুন চিত্রনাট্যে জমে উঠবে রূপালি পর্দা। কিন্তু সব ঠিক হলেও মানতে হবে সামাজিক দূরত্ব। অন্তরঙ্গ দৃশ্য, নায়ক-নায়িকার মাখো মাখো প্রেম, বেড সিন এসব কী থাকবে দৃশ্যে? করোনার চিন্তা মাথায় নিয়ে সে সব দৃশ্যে অভিনয় করতে কতটা স্বাচ্ছন্দবোধ করবেন অভিনেতারা? আর সে সব বাদ দিয়েই বা কী করে ছবি বানানো সম্ভব? চিত্রনাট্যের সঙ্গে আপোস নাকি কলাকুশলীদের সুরক্ষা? কী ভাবছে সিনে দুনিয়া?
এমন প্রশ্ন অনেক আগেই তুলেছিলেন পরিচালক সুজিত সরকার। তিনি বলেন, করোনাতঙ্ক কেটে গেলেও মনের আতঙ্ক কাটবে কী করে? চুমুর দৃশ্য বাদই দিন, হাত ধরাধরি বা কাছে এসে কথা বলা- সেগুলো থাকলেও কী অনুমতি দিবে সেন্সর।
রাজ চক্রবর্তীর কথায়, কলাকুশলীদের সুরক্ষার সঙ্গে আপস যেমন আমি করতে পারব না, ঠিক তেমনই আমার সিনেমার প্লট বদলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ পরিচালক হিসেবে আমি কখনোই চাইব না, সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে।
তবে এরও একটা উপায় বলে দিলেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, যেহেতু আমি ধারাবাহিকের প্রযোজনাও করি সেক্ষেত্রে কাটশটের ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি করতে হবে এক জনের সিনটা আগে তুলে নিয়ে পরের জনেরটা অন্যদিন। পরে দু’টিকে মিলিয়ে দেয়া। এ ঘটনা তো আগেও হয়েছে। আর যেহেতু ফ্যামিলি ড্রামাগুলোতে খুব একটা ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখানো হয় না, তাই কিছুটা কম্প্রোমাইজ করে ধারাবাহিকে কাজ চালিয়ে নেয়া যেতে পারে বলে আমার মনে হয়। কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটাই বেশ অসুবিধের।
এতো গেলো পরিচালকের কথা। যারা সরাসরি অভিনয় করবেন তাদের একজন হলেন অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা সরকার। ভারতীয় গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, চিট শট হোক আর কাট শট পুরো ব্যপারটাই কনফিউজিং। কাজে ফেরা যেমন জরুরি,একই সঙ্গে নিজের নিরাপত্তার কথাও মাথায় রাখা জরুরী। শুটিং শুরু হলে মেকআপ আর্টিস্টরা মেকআপ করবেন। টেকনিশিয়ান কলাকুশলী মিলিয়ে বেশ একটা বড় টিম। দূরত্ব বজায় রাখার গাইডলাইন মেনে হয়তো শর্ট ফিল্ম বা কিছু সিরিজ শুট করা যেতে পারে, কিন্তু ফুল ফ্লেজেড ছবি বানানো যাবে বলে মনে হয় না।
সারেগামা ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট সিদ্ধার্থ আনন্দ কুমার আশা করছেন, জুলাই থেকে তাদের আগামী প্রজেক্টের কাজ শুরু করতে পারবেন তিনি। সেক্ষেত্রে তিনি সুপারিশ করেছেন ব্লকিং টেকনিক। কী সেটি? ওই চিট শটের মতোই অনেকটা। যা যা অন্তরঙ্গ দৃশ্য রয়েছে, তা শুট করা হবে সবার শেষে, যাতে কোনো বিপদ হলেও প্রজেক্টে তার কোন প্রভাব না পরে।
অভিনেত্রী পার্ণো মিত্র বর্তমানে ‘কোড়া পাখি’ ধারাবাহিকের প্রধান চরিত্রে। পরিস্থিতি যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে চিত্রনাট্যেরও যে বদল আনতে হবে সে ব্যাপারে তিনি একমত। তার কথায়, ধারাবাহিকে সেভাবে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য না থাকলেও যতটুকু থাকে, তাতেই ভরসা করতে হবে পরিচালক-চিত্র্যনাট্যকারদের উপর। সুতরাং, করোনায় স্ক্রিপ্ট লেখার সময়েও বারে বারেই মাথায় রাখতে হবে এই সব নির্দেশিকা।
এমন কথায় স্বভাবতই চলে আসে হাত খুলে চিত্রনাট্য লেখার দিন কি শেষ? লেখক যদি মন খুলে চিত্রনাট্য লেখার সুবিধাই না পান তা হলে যা ব্যক্ত করতে চাইছেন তা স্ক্রিনজুড়ে পরিস্ফুট হবেই বা কী করে?
অভিনেতা অঙ্কুশ হাজরা বলেন, পুরো ব্যাপারটায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের। ওই সমস্ত দৃশ্য বাদ দিয়ে কিভাবে তারা বিষয়টা সাধারণের কাছে তুলে ধরবেন? তা দেখার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন তিনিও। কিছু দিন আগে অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথমবার ওয়েব সিরিজে কাজ করেছেন তিনি। বাড়িতে বসে তৈরি করা সেই সিরিজ দর্শকমহলে সাড়া ফেললেও যখন দু’-আড়াই ঘণ্টা ছবির শুট করতে হবে তা কী করে হবে, সে বিষয়ে সন্দিহান তিনি।
ঘনিষ্ঠ দৃশ্য, চুমু, বেডসিন এ সব না হয় বাদই দেয়া গেল। কিন্তু ফাইট সিন? হাওয়ার মতো উড়ে এসে নায়কে মেরে ভিলেনকে উপড়ে ফেলল মাটিতে। গলা টিপে টানতে টানতে সোজা দেওয়ালে ঠুকে দিল মাথা। সেখানেও যে হিউম্যান টাচ!
পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য আবার এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটাই পন্থা দেখতে পাচ্ছেন। যারা যারা অভিনয় করবেন শুটিং শুরুর আগে তাদের টেস্ট করানো। সবাই যখন চিন্তিত, কেউ কেউ যখন ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয়ে সরাসরি না বলে দেবেন বলে জানিয়েছেন, ঠিক সেই সময়েই মধুমিতা সরকারের মুখে উল্টাপুরাণ। তিনি বলেন, বডি টেম্পারেচার মেপে কাজে আসতে হবে। চরিত্রের প্রয়োজনে যদি আমাকে করোনাকালেও ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করতে হয় করব। এত প্যানিক করে কী করব?
কী হবে কেউ জানেন না। তবু কলাকুশলী থেকে টেকনিশিয়ান, সেটে ফিরতে মরিয়া সবাই। কত দিন রোল, ক্যামেরা, অ্যাকশনে মুখর হয়নি সিনে দুনিয়া।
ফেনী ট্রিবিউন/টিএএস/এএএম