ফেনীতে গত এক বছরে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ৬৪টি ঘটনার অভিযোগে বিভিন্ন থানায় মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনায় ৩৭টি মামলা এবং যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ২৬টি মামলা হয়েছে। যৌতুকের জন্য খুনের ঘটনায় মামলা ১টি।
বাংলাদেশ মানবাধিকার সম্মিলন ফেনীর চেয়ারম্যান ও আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম নান্টু বলেন, ধর্ষণের সব ঘটনায় মামলা হয় না। নানা সামাজিক ও পারিবারিক কারণে অনেক ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসে না ও মামলা হয় না। জেলায় ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা উদ্বেগজনক। পুলিশের খাতায় মামলার যে হিসাব আছে-প্রকৃত পক্ষে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা আরো অনেক বেশি হবে।
গত বছর সারাদেশে এক হাজার ৭০৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে গণর্ষণের শিকার হয় ২৩৭ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৭৭ জনকে। ধর্ষণের ঘটনায় আত্মহত্যা করে ১৯ জন। বছরটিতে ২৪৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। আর বছরটিতে ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় চার হাজার ৬২২ জন নারী ও শিশু। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গত বছরের নির্যাতনের এ তথ্য প্রকাশ করে।
এছাড়া গত এক বছরে জেলায় নারী ও শিশু অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৩৭টি, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৮টি। জেলায় নারী ও শিশু নিখোঁজের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় ১৫টি জিডি করা হয়। ২০১৯ সালে সব মিলিয়ে ফেনী জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মোট ১২৯টি মামলা হয়েছে। ২০১৮ সালে জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৭৬টি মামলা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, গত এক বছরে ধর্ষণের ঘটনায় জেলার দাগনভূঞা থানায় ৯টি, সোনাগাজী থানায় ৯টি, ফেনী সদর থানায় ৭টি, ছাগলনাইয়ায় ৬টি, পরশুরাম থানায় ৪টি এবং ফুলগাজী থানায় ২টি মামলা হয়েছে। গত এক বছরে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জেলার ছাগলনাইয়া থানায় ৬টি, ফেনী সদর থানায় ৫টি, দাগনভূঁঞা থানায় ৪টি, সোনাগাজী থানায় ৫টি, পরশুরাম থানায় ৩টি এবং ফুলগাজী থানায় ৩টি মামলা হয়েছে।
গত এক বছরে অপহরণের ঘটনায় জেলার ফেনী সদর থানায় ১৪টি, ছাগলনাইয়া থানায় ৭টি, সোনাগাজী থানায় ৬টি, পরশুরাম থানায় ৩টি, দাগনভূঁঞা থানায় ৩টি এবং ফুলগাজী থানায় ৪টি মামলা হয়েছে। সব ভিকটিম উদ্ধার হয়েছে। গত এক বছরে নারী নির্যাতন ও যৌতুকের ঘটনায় জেলার ফুলগাজী থানায় ৮টি, ফেনী সদর থানায় ৬টি, দাগনভূঁঞা থানায় ৪টি, সোনাগাজী থানায় ৪টি, ছাগলনাইয়া থানায় ৪টি, পরশুরাম থানায় ২টি মামলা হয়েছে। ১২৯টি মামলায় ৩০৫ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ২২২ জন আসামিকে গ্রেফতার করেছে।
ফেনী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রনজিত কুমার বড়ুয়া বলেন, নিখোঁজের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় রুজু হওয়া নারী সংক্রান্ত মামলা ও জিডির সূত্র ধরে এসপির নির্দেশনা অনুযায়ী অধিকাংশ ভিকটিমকে উদ্ধার ও আসামিদেরকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা থেকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। বিভিন্ন থানার পুলিশ ও ডিবি পুলিশের তাৎক্ষণিক তৎপরতার কারণে ২০১৮ সালের তুলনায় জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা কিছুটা হলেও কমেছে।
ফেনীর এসপি খোন্দকার নুরুন্নবী জানান, ফেনীতে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় থানায় মামলা, জিডিসহ অভিযোগ পেলেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে তৎপর হয়ে ওঠেন। যে কারণে প্রায় সবগুলো ঘটনায় ভিকটিম উদ্ধার এবং আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।
২০১৯ সালে দেশব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা ছিল সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে যৌন নিপীড়ন ও পরে হাত-পা বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা। ওই হত্যা মামলায় মাদরাসার অধ্যক্ষসহ ১৬ জন আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে আদালত। আসামিরা কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু যৌন নিপীড়নের মামলাটি এখনো আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
অপরদিকে দাগনভূঞায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক তার বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষণের মামলায় কারাগারে রয়েছেন। ফেনী সদর ও দাগনভূঞার দুজন মাদরাসা শিক্ষক শিশু শিক্ষার্থীকে বলৎকারের অভিযোগে এবং ছাগলনাইয়া অপর এক মাদরাসা শিক্ষক শিশু ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে কারাগারে আছেন।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় নানা শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের সব ঘটনায় থানায় মামলা হয় না। তার প্রধান কারণ সামাজিক অবস্থান। অনেকেই বিষয়টিকে চাপিয়ে যেতে চায়-মেয়েদের বিয়ের কথা বিবেচনা করে। যে ঘটনাগুলো এলাকায় বেশি জানাজানি হয়, সেগুলো থানায় মামলা করা হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ফেনী জেলা সভাপতি, বিশিষ্ট আইনজীবী লক্ষণ বনিক বলেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বেড়েছে। অনেক পরিবার আত্মসম্মানের কথা বিবেচনা করে এসব ঘটনা প্রকাশ বা থানায় মামলা করে না। সব ঘটনায় থানায় মামলা হলে মামলার সংখ্যা অনেক বেশি হতো। তিনি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এসব ঘটনার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
ফেনী ট্রিবিউন/জেএইচ/এএএম