ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার (০৯ সেপ্টেম্বর) সারাদেশে পবিত্র আশুরা উদযাপিত হবে। আশুরা মুসলিম বিশ্বে ত্যাগ ও শোকের একটি দিন। হিজরির সাল অনুসারে ১০ মহররম কারবালায় হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেনের মৃত্যুর দিনটি সারাবিশ্বে মুসলমানরা পালন করেন।
বাংলাদেশেও আগামীকাল মঙ্গলবার যথাযোগ্য মর্যাদায় ও কর্মসূচিতে পবিত্র আশুরা পালিত হবে। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এ উপলক্ষে আগামীকাল মঙ্গলবার সরকারি ছুটি।
হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম এই দিনে মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেইন (রা.) এবং তার পরিবার ও অনুসারীরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শহীদ হন।
এ ঘটনা স্মরণ করে বিশ্ব মুসলিম যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করে থাকে। শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে তাদের এই আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। কারবালার এই শোকাবহ ঘটনা ও পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী সকলকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে প্রেরণা যোগায়।
এ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আগামীকাল হোসনি দালানসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাজিয়া মিছিল বের হবে। মিছিলটি ধানমন্ডি লেকে এসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক আগামীকাল বিশেষ প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশ করবে। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি রেডিও-টিভি চ্যানেলও এই দিনের তাৎপর্য নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া শোক মিছিলে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন। রাজধানীর বড় কাটারা ইমামবাড়া, খোজা শিয়া ইসনুসারী ইমামবাড়া এবং বিবিকা রওজায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রতিটি ইমামবাড়া সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে প্রত্যেক দর্শনার্থীর দেহ তল্লাশি করে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করানো হবে।
ডিএমপি কমিশনার তাজিয়া মিছিলে ঢোল বাজিয়ে দা, ছুরি, তলোয়ার ও লাঠিখেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে জানিয়ে আরো বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে এসব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১২ ফুটের বেশি বড় নিশান মিছিলে ব্যবহার করা যাবে না। আগুনের ব্যবহার করা যাবে না। মিছিলে ব্যাগ, পোঁটলা, টিফিন ক্যারিয়ার বহন করা যাবে না। মাঝপথে কেউ মিছিলে অংশ নিতে পারবেন না বলেও জানান তিনি।
সংক্ষেপে মহররমের স্মরণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো:
(১) মহররম মাসেই মহান আল্লাহ তায়ালা এ পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং এদিন কেয়ামত ঘটাবেন।
(২) পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া আলাহিস সালাম শয়তানের প্রতারণায় মহান আল্লাহর হুকুম লংঘন করে তার শাস্তির সম্মুখীন হন।
(৩) মহান আল্লাহ তায়ালা এ মাসেই আরাফাতের ময়দানে হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া আলাইহিস সালামকে একত্রিত করেন।
(৪) এ পবিত্র মাসেই মহান আল্লাহ তায়ালা হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করে দেন।
(৫) হজরত নূহ আলাইহিস সালাম মহাপ্লাবনের পর তিনি ও তার উম্মতগণসহ এ মাসেই পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করেন।
(৬) মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের জন্য নমরুদের অগ্নিকুণ্ডলী শান্তিতে পরিণত হয় এ মাসেই। তাওহিদের দাওয়াত দেয়ার অপরাধে তৎকালীন জালিম শাসক নমরুদ হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে অগ্নিকুণ্ডলীতে নিক্ষেপ করেছিলেন।
(৭) মহান আল্লাহর নবী বাদশাহ হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম এ মাসেই তার রাজত্ব ফিরে পেয়েছিলেন।
(৮) হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে মহান আল্লাহ তায়ালা মহররম মাসেই ফেরাউনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করেন এবং ফেরাউনের দম্ভ চূর্ণ করে তাকে দলবলসহ নীল নদে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেন।
(৯) হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান।
(১০) সর্বোপরি প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাণপ্রিয় নাতি হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু কুফাবাসীর আমন্ত্রণে দুনিয়াতে উত্তম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করতে কুফায় যাওয়ার পথে কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদের নির্দেশে প্রধান সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ জিয়াদের সৈন্যবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন।
মহররম মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদার মাস। হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে ইসলামের অনেক ঘটনাই এ মাসে সংঘটিত হয়েছে।
ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে এবং আল্লাহর জমিনে তাঁর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করতে এ দিনের তাৎপর্য, গুরুত্ব এবং মর্যাদা উপলব্দি করে উত্তম প্রতিষ্ঠায় তা বাস্তবায়ন করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানের দাবি।
পবিত্র আশুরার রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত:
পবিত্র আশুরা দিবসে রোজা পালনের জন্য আমাদের প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল (সা.) বলেন, রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।’ (সুনানে কুবরা: ৪২১০)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর সর্বাধিক উত্তম রোজা হলো মহররম মাসের রোজা। আর ফরজের পরে সর্বাধিক উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।’ (মুসলিম: ১/৩৫৮)
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আশুরার রোজা ফরজ ছিলো। দ্বিতীয় হিজরি সনে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার বিধান নাজিল হলে আশুরার রোজা ঐচ্ছিক হিসেবে বিবেচিত হয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এই রোজা নিজে পালন করেছেন। উম্মতকে রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তাই এর পূর্ণ অনুসরণ ও আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে উম্মতের কল্যাণ। আবু কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়।’ (মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)
আরো বর্ণিত আছে, ‘আশুরা দিবসের সাওম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, এর ফলে আগের বছরের গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’ (মুসলিম: ১/৩৫৮)
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘জাহিলিয়া যুগে কুরাইশরা আশুরা দিবসে রোজা পালন করতো। রাসূলুল্লাহ (সা.)-ও সে কালে রোজা পালন করতেন। মদিনায় এসেও তিনি রোজা পালন করতেন এবং অন্যদেরও নির্দেশ দিলেন। রমজানের রোজার আদেশ নাজিল হলে আশুরা দিবসকে বর্জন করা হয়। এখন কেউ চাইলে তা পালন করুক, আর চাইলে তা বর্জন করুক।’ (বুখারি: ১/২৬৮)
মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে আশুরার রোজা পালনসহ সকল ত্যাগ ও ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে তা বাস্তবায়ন এবং ইবাদাত-বন্দেগি করে তাঁর নৈকট্য অর্জন ও ক্ষমা লাভের তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।
ফেনী ট্রিবিউন/আরএজে/এপি