আঞ্চলিক পর্যায় থেকে শুরু হওয়া একটি প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বাণিজ্যিক গ্রুপ স্টার লাইন। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিত এ গ্রুপটি। পরিবহন ব্যবসা দিয়ে এর যাত্রা শুরু।
স্টার লাইন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক জাফর উদ্দিন শুরুর গল্পটা এভাবে বলেন, ৯০ দশকের শেষদিকে সাবেক মন্ত্রী জাফর ইমাম ও তাজুল ইসলামসহ প্রতিষ্ঠানটির আরেক পরিচালক হাজী আলাউদ্দিন (বর্তমানে ফেনী পৌরসভার মেয়র) মিলে ‘স্টার লাইন’ নাম দিয়ে পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ১৯৯৪ সালে চারটি বাস দিয়ে শুরু হয় সে ব্যবসা। ব্যবসায় তারা ক্ষতির সম্মুখীন হলে ১৯৯৭ সালে এটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরের বছর দুটি বাস দিয়ে ১৯৯৮ সালের ১৫ নভেম্বর নতুন করে পরিবহন ব্যবসায় আসেন হাজী আলাউদ্দিনের ভাই জাফর উদ্দিন। তিনি তখন ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মেজ ভাই হাজী আলাউদ্দিনের পরামর্শ নিয়ে ফেনী-ঢাকা রুটে ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে ফেনী-চট্টগ্রাম, ফেনী-কক্সবাজার, ফেনী-খাগড়াছড়ি,
সিলেট-চট্টগ্রাম, খুলনা-চট্টগ্রাম, বসুরহাট-ঢাকা, বারইয়ারহাট-ঢাকা রুটসহ ফেনীর সবকটি উপজেলা থেকে ঢাকা রুটে এই সার্ভিস চালু রয়েছে। স্টার লাইন পরিবহনের অধীনে বর্তমানে তিন শতাধিক গাড়ি বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে।
‘স্বাদে অনন্য সবার জন্য’ স্লোগান ধারণ করে অল্প সময়ের মধ্যে ভোক্তাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে স্টার লাইন ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড। এর কারখানা ফেনী শহরের অদূরে ফেনী-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক সংলগ্ন দক্ষিণ কাশিমপুরে। ১৯৯৮ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় প্রতিষ্ঠানটি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এর বাজার বিস্তৃত হয়েছে সৌদি আরব, কাতার, আবুধাবি ও দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি প্রদেশে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৫ সালে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মো. আশরাফুলকে গ্রুপটির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে মো. সাইফুদ্দিনক ও ২০১৭-১৮ সালের জন্য অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমনকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
প্রথম পুঁজির বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালক জাফর উদ্দিন বলেন, আমার বড় ভাই হাজী নিজাম উদ্দিন ১৯৮৫ সালে সৌদি আরব গমন করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে সৌদি আরবে আবাসিক হোটেলের ব্যবসা করতেন। ব্যবসা শুরুর পর তার কাছে পুঁজি চাইলে প্রথমে অনীহা দেখান। পরে মায়ের অনুরোধে আমার জন্য টাকা পাঠান। এক বছরে স্টার লাইন সুনাম অর্জন করে। পরের বছর ভাইয়ের দেওয়া টাকাসহ মর্টগেজ ছাড়া ব্যাংকঋণ নিয়ে আরও দুটি গাড়ি চালু করি। এরপর প্রতি বছর দুই থেকে চারটি করে গাড়ি যোগ করতে থাকি। পরিবহন খাতে সফলতার পর আমাদের গ্রুপ দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য শিক্ষা ও খাদ্য খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।
বর্তমানে এ গ্রুপের অধীনে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০০৪ সালে ‘স্টার লাইন পেট্রোল পাম্প ও সিএনজি পাম্প’ চালুর মধ্য দিয়ে এটিকে গ্রুপে রূপান্তরের স্বপ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ গ্রুপের অধীনে বর্তমানে ৩০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানই সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছে। ২০০৫ সালে ‘স্টার মোটরস’ নামে নতুন প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানি করে থাকে। ২০০৬ সালে দুটি সিএনজি পাম্প চালু করা হয়। একই বছর ‘স্টার লাইন ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ‘স্টার লাইন ব্রিকস ফিল্ড’র দুটি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৯ সালে ‘স্টার লাইন অটোব্রিকস’ কারখানা চালু হয়। একই বছর ‘স্টার লাইন স্প্রাউট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ নামে জেলার প্রথম ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠা করে গ্রুপটি। ওই একই বছর ‘অটো রাইস মিল’র কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ‘ফেনী ন্যাশনাল কলেজ’ চালু করে। কলেজটি এইচএসসি পরীক্ষায় বেসরকারিভাবে প্রথম হয়েছে ফেনীতে। ২০১০ সালে ‘স্টার লাইন মেজর ফ্লাওয়ার মিল’, ‘স্টার লাইন ফুড প্রোডাক্টস’ এই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়। ২০১১ সালে স্টার লাইন প্রপার্টিজ লিমিটেডসহ মুড়ি, সেমাই ও নুডলসের ফ্যাক্টরি নির্মাণ করা হয়। ২০১২ সালে ‘স্টার লাইন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস’ ও সাপ্তাহিক ‘তারা’ পত্রিকা চালু হয়। ২০১৩ সালে ‘দৈনিক স্টার লাইন’ পত্রিকা প্রকাশ করে। একই বছর ‘স্টার লাইন ফিশারিজ’র কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৪ সালে ‘স্টার লাইন প্যাকেজিং’ ও ২০১৫ সালে ‘স্টার লাইন সুইটস’র কার্যক্রম শুরু হয়। আরও রয়েছে সয়া প্রসেসিং, ডাল প্রসেসিং, স্টার লাইন কার্টন অ্যান্ড প্যাকেজিং, স্টার লাইন অফসেট প্রিন্টিং প্রেস, স্টার লাইন পোলট্রি অ্যান্ড ফিশারিজ,
এরশাদ-নাহার ফাউন্ডেশন, স্টার লাইন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল (প্রস্তাবিত), হোটেল দার আল-হালওয়ানি, হলি মক্কা-সৌদি আরব, নাহার এন্টারপ্রাইজ ও নাহার ট্রেডিং।
সেবা খাতে ‘স্টার লাইন স্পেশাল লিমিটেড’ ও উৎপাদন খাতে ‘স্টার লাইন ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড’ কুমিল্লা অঞ্চলে সর্বোচ্চ ভ্যাটদাতা হিসেবে চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ‘সেরা ভ্যাটদাতা’র পুরস্কার ও স্বীকৃতি পাচ্ছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি পুরস্কার লাভ করেছে স্টার লাইন গ্রুপ।
গ্রুপটির পরিচালক ও ফেনী পৌরসভার মেয়র হাজী আলাউদ্দিন বলেন, আমি বিশ্বাস করি সততা, কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন ও কমিটমেন্ট রক্ষা করাই সফলতার চাবিকাঠি। এ ক্ষেত্রে লেনদেনের কমিটমেন্ট ঠিক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি রক্ষা করতে না পারলে ব্যবসায় সফল হওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। স্টার লাইন শিল্পপরিবার একের পর এক সম্ভাবনার মাইলফলক রচনা করেছে এ জনপদে। প্রাথমিক উদ্যোগে ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা ও সবার উৎসাহকে কাজে লাগানোর শক্তিই শিল্পোদ্যোক্তা এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্টার লাইনকে দুটি মৌলিক বিশেষত্ব প্রদান করেছে: একটি হলো চিরাচরিত শহরমুখিতা পরিহার; অপরটি মৌলিক শিল্প প্রতিষ্ঠা।
সম্পাদনা : এএএম/এসটি