প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই মৃত্যুর সংবাদ শুনি। কেউ না কেউ চলে যাচ্ছে। কি বুড়ো কি যুবক কি সাংবাদিক কি গায়ক,সবাই চলে যাচ্ছে, মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
এড. মিজানুর রহমান ফিরোজ। বয়স ৩৮। আমার কাজিন। ছিলেন আপন ভাইয়ের মতো। পড়াশুনা করেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ও কুমিল্লা ‘ল’ কলেজে ।
মাস্টার্সের পর এলএলবি সম্পূর্ণ করে বার কাউন্সিলের মাধ্যমে ২০১৬ সালে ফেনী জজ কোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। পাশাপাশি কুমিল্লা শহরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
গত ৫ বছর সুনামের সাথে বিপদগ্রস্ত মানুষদেরকে অাইনি সহায়তা দিয়ে আসছেন।
ফেনীতে এত অল্প সময় থেকেও ছোট-বড় সব মানুষের ভালোবাসা অর্জন করছেন।
রাতে উনার সহকর্মী বিশিষ্ট আইনজীবীরা যেভাবে খোঁজখবর নিল উনার প্রতি যে ভালোবাসা দেখালো তাতেই অামার নির্ঘুম রাত কেটে গেল।
ব্যক্তি জীবনে প্র্যাকটিসিং মুসলিম ছিলেন। ছিলেন সাংগঠনিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ছোটকাল থেকেই তিনি সদা হাস্যজ্জ্বল, সদালাপী ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে তার মধ্যে অসংখ্য সামাজিক গুণের সন্নিবেশন ছিল। মাশা-আল্লাহ ছিলেন সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী। অহংকারবোধ বা আখলাকে যামিমা কখনো তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
উনার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা এলাকার কেউ কখনো বলতে পারবেনা, কারো সাথে কখনো তিনি কটু কথা বা মন্দ আচরণ করছেন।
ভাইয়া আমাকে খুব আদর করতেন। দেখা হলেই বলতেন, কি খবর ভাইয়া, কেমন আছিস? কাকা, চাচি আম্মাসহ সবাই কেমন আছে?
২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ভাইয়ার উদ্যোগে অামরা কাজিনেরা মিলে “আল-ইনসাফ সমবায় সমিতি” নামে একটি সমিতি গঠন করি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভাইয়া সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
এই সমিতিকে নিয়ে ভাইয়ার কত যে পরিকল্পনা ছিল।
ভাইয়ার পরিবার কুমিল্লাতে থাকলেও পেশার সুবিধার্থে তিনি ফেনী শহরের নাজির রোডের একটি বাসায় থাকতেন। তার জন্য আমার সাথে প্রায়ই দেখা হতো।
গত সপ্তাহও একসাথে মাগরিবের নামাজ পড়ে কুমিল্লা বাস স্ট্যান্ডে আমাদের সমিতিসহ করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কথা-বার্তা বলেছিলাম। তখন ভাইয়া মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
গত রবিবার একটা কাজে ভাইয়াকে ফোন দিলাম ভাইয়া বলল, আমার জ্বর দোয়া করিস। তখন ভাইয়াকে ভিটামিন সি ও ডি জাতীয় খাবার খেতে বললাম,সতর্ক থেকে ডাক্তার দেখাতে বললাম। ফোন রাখার সময় ভাইয়া বলল, ফেনীতে এসে তোকে কল দিয়ে মিট করবো।
মিট করা আর হলো না।
জ্বর থেকে শ্বাস-কষ্ট শুরু হলে কুমিল্লা মেডিকেলে ভর্তি করানো হয় ভাইয়াকে। অবস্থা গুরুতর হয়ে গেলে ICU’র প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু কুমিল্লা মেডিকেলের সব ICU বেডে রোগী ভর্তি। শারীরিক অবস্থার কারণে ঢাকা বা চট্টগ্রামেও নেয়া যায়নি ।
করোনার উপসর্গ নিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন ভাইয়া। জানাযাটাও পড়তে পারলাম না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংক্ষিপ্ত আকারে রাত ১.০০ টায় দাফন কাজ সম্পূর্ণ করা হয়।
নিভে গেল একটি জ্বলন্ত প্রদীপ। একটি ছন্দময় ও গতিময় জীবনের অবসান হয়ে গেল।
স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা আমাদের অন্যতম মৌলিক অধিকার “স্বাস্থ্যসেবায়” আস্থা অর্জন করতে পারেনি। কোনো সরকারই একটি সুন্দর স্বাস্থ্যসেবা দাঁড় করাতে পারেনি।
দেশের সব হাসপাতালেই কোনো না কোনো সমস্যা লেগেই আছে । ডাক্তার আছে তো চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই,করোনা টেস্টের কীট নেই,পর্যাপ্ত ICU বেড নেই। স্বাস্থ্যসেবায় পুরো হযবরল অবস্থা চলছে।
কবে আমাদের হুঁশ ফিরে আসবে,কবে আমরা মানুষ হবো!
ICU’র সাপোর্টটা পেলে হয়তো ভাইয়া বেঁচে থাকতেন।
উনার পরিবারও কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেতেন।
ভাইয়ার এক বছর বয়সী একটা কন্যা সন্তান আছে কে দিবে তাকে পিতা হারানোর সান্ত্বনা!
পরিশেষে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি,হে আল্লাহ তুমি প্রিয় ভাইটিকে শহিদ হিসেবে কবুল করে উনার কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দাও। উনার সব গুনাহ ক্ষমা করে তোমার উত্তম বান্দা হিসেবে কবুল করো এবং পরিবারের সকলকে ধৈর্য ধরার তাওফিক দাও।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে প্রতিটি মৃত্যু থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের জীবনকে তোমার বিধানানুযায়ী সাজানোর তাওফিক দাও। আমিন।