শুরুতেই প্রমথ চৌধুরীর কথা স্মরণ করছি যিনি ধন-সম্পদের তুলনায় সাহিত্যে যে বিশাল আরও মূল্যবান সেটাই তিনি বলেছেন,‘‘যে জাতি মনে বড় নয়,সে জাতি জ্ঞানেও বড় নয়;কেননা ধনের সৃষ্টি যেমন জ্ঞান সাপেক্ষে তেমনি জ্ঞানের সৃষ্টি মন সাপেক্ষে এবং মানুষের মনকে সরল,সচল,সরাগ ও সমৃদ্ধ করার ভার আজকের দিনের সাহিত্যের ওপর ন্যস্ত হয়েছে।’’সুতরাং সাহিত্যের চর্চাও আবশ্যক যেমনটা শিক্ষা অর্জন আমরা আবশ্যক মনে করছি। শিক্ষার সর্বপ্রধান শাখা সাহিত্যে চর্চা।
‘‘অন্তরের জিনিসকে বাহিরের,ভাবের জিনিসকে ভাষায়, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ।’’সর্বপ্রধান শাখা সাহিত্যে হলেও এটা সত্য যে সাহিত্যের রস সকলে সানন্দে গ্রহণ করতে চায় না কারণ এই রসের সাথে অর্থের রস পারস্পারিক আকর্ষণ করে না। প্রত্যেক মানুষেরই কিছু কথা থাকে,থাকে গল্প বা অনুভূতি। আর এ কথাকে বা গল্পকে লিখে ফেলাই সাহিত্যের কাজের মধ্যে পড়বে না। যখন গল্প বা যেকোনো লিখা গবেষণামূলক অথবা অনুসন্ধানমূলক হবে তখনই তা সাহিত্যের পর্যায়ে পড়বে।
এজন্যই সাহিত্যে এতো শক্তিশালী কারণ এটি সম্ভাবনাকে বাস্তবে রুপদানে সক্ষম। সাহিত্যে এমন একটি রস যে রসে ডুবে থাকলে শরীরের সকল শিরা উপশিরা এমনকি ধমনীতেও সে রস নিমিষে পৌঁছে যায়। নিমিষেই ব্যক্তির মধ্যে প্রাণের ছোঁয়া লাগে। এর ফলে ব্যক্তির মধ্যে সম্ভাবনা আসে,আসে অনুভূতির এক কাল্পনিক শক্তি।সৈয়দ শামসুল হককে একটা সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মানব জীবনে সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা কতোটুকুন। তখন তিনি বলেছিলেন,‘‘এই যে আমরা এতো সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলি,সুন্দর শব্দ চয়ন করি,ভাষার অলংকরণ করে নিজের ভাব,মতামত প্রকাশ করি সকল কিছুই সাহিত্যের থেকে শেখা।’’
সাহিত্যে বিবেকহীন মানুষকে বিবেকবান করে গড়ে তুলে,মূর্খকে মূর্খতার হাত থেকে বাঁচিয়ে জ্ঞানীর দরবারে নিয়ে যেতে পারে,নির্জীব প্রাণকে সজীব করে তোলে।আদর্শ, নীতিবান এবং মহৎ মানুষ গড়ার কারিগরও কিন্তু এই সাহিত্যেকে বিবেচিত করা যেতে পারে যেমনঃকোলরিজের এনশিয়েন্ট মেরিনার কবিতাটি আমাদেরকে ন্যায়রায়ণতা শেখায়। সাহিত্য আমাদেরকে প্রথমত আক্রান্ত করে অনুভবে। পরে তা আমাদের চেতনাকে নিয়ে যায় জীবনের পথে।
ব্যাক্তির চেতনাকে জাগিয়ে তোলা সাহিত্যের অন্যতম কাজ। আর অভ্যন্তরীণ চেতনা জাগ্রত হলেই নি:সন্দেহে যে কেউ মহৎ,নীতিবান এবং সৎ হতে পারবে। সাহিত্যেচর্চার ফলে ব্যাক্তির মধ্যে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। নতুন কিছু সৃষ্টি করাই তাঁর পেশা এবং নেশা হয়ে দাঁড়ায়। শুধুমাত্র শিক্ষা আমাদেরকে মানবসত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারবে না। চাই সঠিক শিক্ষা যে শিক্ষার সাথে থাকবে না কোনও লেনদেন বা অর্থ উপার্জনের নেশা,থাকবে না কোন পিছুটান,থাকবে না কোনও উদ্দেশ্য।
যেখানে উদ্দেশ্য থাকবে সেখানে কখনো মানবসত্তার অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারে না,পারে নি এবং কখনোও পারবে না। সঠিক শিক্ষা লাভের জন্য সাহিত্যে চর্চার কোনও অংশে কমতি নেই। উদ্দেশ্য প্রনোদিত হয়ে সাহিত্যে চর্চা করলে সেই সাহিত্যে সকলের মনোরঞ্জন করতে ব্যর্থ হবে। সাহিত্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীও কিন্তু এটাই বলে গিয়েছেন যে,‘‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া কারও মনোরঞ্জন করা নয়।’’মননশীলতা বা সৃষ্টিশীলতা হচ্ছে সাহিত্যের প্রাণ স্বরূপ যেই প্রাণ অন্য প্রাণকে সজীব করতে সক্ষম।
সকল কিছুর পাশাপাশি বই পড়ারও অভ্যাস বেশির থেকে বেশি থাকতে হবে।সকল ধরনের বই পড়তে হবে সেটা যেই বই-ই হোক না কেনও। বই পড়া ছাড়া সাহিত্যচর্চার উপায়ান্তর নেই। এটা আমার কথা নয় প্রমথ চৌধুরীই বলে গেছেন। বই পড়তে থাকলে ধীরে ধীরে আপনি নিজেকে একজন জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।
তবে এই বই সাহিত্যের বই হতে হবে। সাহিত্যের বই ছাড়া একজন জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হওয়াটা অসম্ভব। তবে যারা বই ছাড়া ধ্যান এবং তপস্যার দরুণ জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হয়েছিলেন তাঁদের কথা এই প্রযুক্তি নির্ভর ও যান্ত্রিকতার যুগে না বলায় শ্রেয় বোধ করছি কারণ তাঁরা উত্তম আর আমরা অধম।
আমাদের সময়টুকুন মোটেও ভালো যাচ্ছে না। এই অসময়ে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হওয়াটা জরুরি। যদি এই অসময়ে কেউ সঠিক ও উপযুক্ত কাজ করতে পারে তবে সে সত্যিকার অর্থে জ্ঞানীদের দলে প্রবেশ করতে পারবে। সুতরাং এই দুর্দিনে নিজ অস্তিত্ব ও সত্তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য সাহিত্যের পাঠ এবং চর্চা উভয়েরই বেশ প্রয়োজনীয়তাবোধ করছি।
প্রিয় কবি ও প্রাবন্ধিক, জাহাঙ্গীর আলম ও মোজাম্মেল হোসেন স্যার আমার অনেক প্রিয় লেখক। মোজাম্মেল হোসাইন স্যারের কবিতা গুলো আমাকে বরাবর বাংলা সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলে। স্যারের লেখা অন্যতম কবিতা গুলো অশ্রুতে ভাসে ঈদ, শান্তনা ও বিরহ রাত ইত্যাদি। স্যারের লেখা প্রতিটি লাইনেই রয়েছে রহস্য ও সাহিত্যের ভরা সন্ধি। যেখানে আমরা তরুন প্রজন্ম সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠছি। আধুনিকতার এইযুগে মানুষ সাহিত্য চর্চাকে সময় অপচয় ভেবেই নিয়েছে। অথচ যুগ যুগ ধরে বাংলা সাহিত্য ও কবিতা এই অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের মাঝে মিশে আছে।
তেমনি কবি ও প্রাবন্ধিক জাহাঙ্গীর আলম স্যার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য নিরলস ভূমিকা পালন করে আসছেন। স্যারের সংস্কৃতি ও সাহিত্য প্রেম বরাবরই আমাকে অনুপ্রাণিত করেন। স্যার লেখা অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা (দিগ্বালিকা, খুলে দাও সব দ্বার, বাংলাদেশ, কে তুই, রুখে দাও সব আগ্রাসন, প্রেমহীন পৃথিবী) ইত্যাদি।
এছাড়াও এইবছর অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ” ভালোবাসা রঙ বদলায় ” বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে৷ যেখানে প্রতিটি গল্পই পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। স্যারের লেখা প্রবন্ধ গুলো যেন এই প্রজন্মের জন্য এক অনন্ত সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্য নক্ষত্র হিসেবে ফুটে উঠুক এইসময়ের প্রিয় শিক্ষক ও লেখক জাহাঙ্গীর আলম স্যার ও মোজাম্মেল হোসাইন স্যার। ভালোবাসা রইল আপনাদের প্রতি৷ রইল এই প্রজন্মকে বাংলা সাহিত্যকে নতুন রূপে ফিরিয়ে দেয়ার বিশেষ কৃতজ্ঞতা।
ফেনী ট্রিবিউন/এএএম/এপি