বাংলা চলচ্চিত্রের অমর নায়ক সালমান শাহর মৃত্যুবার্ষিকী ৬ সেপ্টেম্বর। দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন চ্যানেল এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। কারণ এ নায়ক যে মিশে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।
সালমান শাহ্ নামে সবাই চিনলেও তার আসল নাম ছিলো শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। ঢাকাই ছবিতে তার আগমন হয়েছিলো ধূমকেতুর মত। মাত্র তিনবছরের ক্যারিয়ারে উপহার দিয়েছিলেন ২৭টি দর্শকপ্রিয় ছবি। স্টাইল আর অভিনয় দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য এক উচ্চতায়। চলচ্চিত্রের কথা বলতে গিয়ে আজও তার স্মৃতি হাতরে বেড়ান সালমান যুগের মানুষরা।
সালমান নামের এই ধূমকেতুর পতন হয় রহস্যজনক এক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তবে একটুও ম্লান হয়নি তার আলোর। আজও ঢাকাই ছবিতে রোমান্টিক, সফল নায়কদের উদাহরণ সালমান।
আগামীকাল হতে যাচ্ছে সালমান শাহকে হারানোর ২৩ বছর। অল্প সময়ের ক্যারিয়ারেই তিনি জয় করেছিলেন অগনিতভক্তের হৃদয়। তার ভক্তদের আগ্রহের শেষ নেই প্রিয় নায়কের জীবনী ও তার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বিষয়ের প্রতি।
আরো মজার ব্যাপার, সালমান যুগের না হয়েও এ প্রজন্মের সিনেমাপ্রেমীরাও সালমানকে মানেন নায়কের আদর্শ হিসেবে। দেশের বিভিন্ন হলে সালমানের পুরনো ছবিগুলো মুক্তি পেলে দর্শক উপস্থিতি তারই প্রমাণ দেয়।
১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট সামিরার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সালমান শাহ্। এরপরে ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন তিনি। প্রথম ছবিতেই নায়িকা হিসেবে জুটি বেঁধেছিলেন মৌসুমির সঙ্গে। তিন বছরের ক্যারিয়ারে সর্বাধিক ছবিতে জুটি বেঁধেছিলেন শাবনূরের সঙ্গে।
দিনটি ছিল শুক্রবার। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাতে বা সকালের কোনো এক সময় মৃত্যু হয় সালমান শাহ্। অভিনেতার মৃত্যুর পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, তার আগের দিন অর্থাৎ ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘প্রেমপিয়াসী’ ছবির ডাবিং করতে এফডিসিতে যান সালমান শাহ। সেখানে ডাবিংয়ের জন্য আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন ছবির নায়িকা শাবনূর। এফডিসিতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর সালমান তার বাবাকে ফোন করে বলেন, তার স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে এফডিসির সাউন্ড কমপ্লেক্সে আসার জন্য। ফোন পাওয়ার পরপরই সালমানের বাবা সামিরাকে নিয়ে এফডিসি যান।
শ্বশুরের সঙ্গে সাউন্ড কমপ্লেক্সে এসে সামিরা দেখতে পান সালমান ও শাবনূর ডাবিং রুমে খুনশুটি করছেন। সামিরাকে উত্তেজিত করে তোলার জন্য সালমানের ঘনিষ্ঠরা বিভিন্ন সময় বলেছেন, সালমান প্রায়ই শাবনূরের সঙ্গে এ ধরনের খুনশুটি করতেন। সালমানকে শাবনূরের সঙ্গে খুনশুটি করতে দেখে রেগে যান সামিরা। সালমানের বাবা চলে যাওয়ার পর সামিরাও দ্রুত গাড়িতে ওঠেন। ‘অবস্থা জটিল’ বুঝতে পেরে একই গাড়িতে ওঠেন সালমান শাহ ও চিত্রপরিচালক বাদল খন্দকার। কিন্তু গাড়িতে বসে সালমানের সঙ্গে কথা বলেননি সামিরা। তাকে বোঝাতে থাকেন বাদল খন্দকার।
সামিরার গাড়ি এফডিসির গেট পর্যন্ত গেলে সালমান প্রধান ফটকের সামনে নেমে যান। তার সঙ্গে বাদল খন্দকারও নেমে পড়েন। এরপর সেখানে কিছুক্ষণ কথা বলেন তারা। অথচ নিজ ক্যারিয়ারের তিন বছরে এর আগে একবারের জন্যেও গেটে কথা বলেননি সালমান শাহ্। বিষয়টি তখনকার নিরাপত্তাকর্মীদেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তারা কানাঘুষা করছিলেন এ নিয়ে। এরপর ডাবিং রুমে ফিরে গেলেও ঠিকমতো ডাবিং হয়নি।
সেদিন রাত ১১টার দিকে নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বি-১১ নম্বর ফ্ল্যাটে সালমানকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন বাদল খন্দকার। সামিরা তখন ঘরে থাকা সত্ত্বেও সালমানের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেডরুমে গিয়ে টিভি দেখেন সালমান। এরপর ১২টার দিকে তার মোবাইলে একটি ফোন আসলে তিনি বাথরুমে গিয়ে কথা বলেন।
কথা বলা শেষে বাথরুম থেকে বেরিয়ে টিভি বন্ধ করে অডিও ক্যাসেট ছাড়েন সালমান। এ সময় আরো একটি ফোন আসে সালমানের কাছে। এবার মুখ খুলেন সামিরা। সন্ধ্যার ঘটনা নিয়ে দু’জনের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। উত্তেজিত হয়ে তখন সালমান তার মোবাইল ফোনটি ভেঙে ফেলেন। এতে সামিরা বেশ ক্ষুব্ধ হন। ব্যাগ গুছিয়ে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে ফুফুর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যান। সালমানের পিএ আবুলকে ইন্টারকমে কথা বলতে বলেন। আবুল ইন্টারকমে অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ানকে গেট না খুলতে নিষেধ করেন। গেটে বাধা পেয়ে সামিরা আবারো ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন। তখন সালমান তাকে সকালে ফুফুর বাড়ি পৌঁছে দেবেন বলে কথা দেন। এরপর সামিরা বেডরুমে চলে যান।
এরপর দিন ৬ সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই ‘তুমি শুধু তুমি’ ছবির শুটিং ছিল। সেখানে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সালমান ঘুমাতে থাকেন। সকাল সাতটার দিকে সালমানের বাবা ছেলের ফ্ল্যাটে আসেন। সামিরা গেট খুলে দেন। সালমানের বাবা বলেন- মা, ভাই ও তাকে নিয়ে সিলেটে যাবেন। এ সময় সিদ্দিক নামের এক প্রযোজকও আসেন। কিন্তু সালমান ঘুম থেকে না ওঠায় কিছুক্ষণ অবস্থানের পর সালমানের বাবা ও সিদ্দিক চলে যান।
এরপর সামিরা তার বেডরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। বেলা ১১টার দিকে সালমান ঘুম থেকে উঠে কাজের মেয়েকে ডেকে পানি ও চা পান করেন। কিছুক্ষণ পর ড্রেসিংরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লক করে দেন। ঢোকার আগে সহকারী আবুলকে বলেন, আমাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে। অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও ড্রেসিংরুম থেকে সালমানকে বের না হতে দেখে আবুল চিন্তায় পড়ে যান। সাড়ে ১১টার দিকে সামিরাকে জাগিয়ে বলেন, অনেকক্ষণ আগে ড্রেসিংরুমে ঢুকলেও তার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
সামিরা দরজার ডুপ্লিকেট চাবি খুঁজে বের করে ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে দেখেন ফ্যানের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছেন সালমান! সঙ্গে তখন আবুলও ছিল। তাদের ডাকে পাশের বাসার কাজের মেয়েও উপস্থিত হয়। এ সময় সামিরা ও সালমানের দুই কাজের মেয়ে সালমানকে উঁচু করে ধরেন। পাশের বাসার কাজের মেয়ে দড়ি কেটে সালমানকে নামিয়ে আনেন। দড়িটি ছিল ব্যায়ামের যন্ত্র থেকে বের করা। ধারণা করা হয়, সালমান ফ্যান পর্যন্ত ওঠেন ঘরে থাকা একটি কাঠের মই দিয়ে। ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় থেকে সালমানকে নামানোর পর পাশের বাসার কাজের মেয়ে বলে, শরীর এখনো গরম। উনি মরেননি।
তখন মাথায় ও গায়ে তেল মালিশ করা হয়। ততক্ষণে সামিরা তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী রুবিকেও খবর দেন। পাশেই তার বিউটি পার্লার। তিনিও চলে আসেন। রুবিও এসে সালমানে গায়ে তেল মাখানো শুরু করেন। এরপরে খবর পেয়ে হাউজিং কমপ্লেক্সের ম্যানেজারও আসেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শুটিংয়ের খবর নিতে প্রডাকশন ম্যানেজার সেলিম এসে সালমান শাহকে মরার মতো পড়ে থাকতে দেখে সালমানের বাবাকে খবর দেন। খবর পেয়ে সালমানের বাবা, মা ও ছোট ভাই ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে।
তারা গিয়ে সালমানকে হাসপাতালে দ্রুত নেয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু এ সময় লিফটের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আরো ১৫ মিনিট দেরি হয়। পরে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন সালমান শাহ। পরিবারের বড় ছেলে ছিলেন তিনি। দাদার বাড়ি সিলেট শহরের শেখঘাটে। যে বাড়ির এখন ‘সালমান শাহ হাউস’ নামে রয়েছে। নানার মূল বাড়ি ছিল মৌলভীবাজারে। বর্তমানে সিলেটের দারিয়া পাড়ায়। মৃত্যুর আগে সালমান শাহের শেষ ছবি ছিল ‘বুকের ভেতর আগুন’।
সম্পাদনা : এএএম/এপি/টিএএস