সাবেক এই মন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। গত একমাস ধরে তিনি অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
তরিকুল ইসলাম ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে প্রথমে সমাজকল্যাণমন্ত্রী এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে আসার আগে তিনি সহ-সভাপতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
তরিকুল ইসলামের মৃত্যুতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
তরিকুল ইসলামের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম ছিলেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। জীবদ্দশায় তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনৈতিক অঙ্গনকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে আলোকিত করেন তিনি। রাজনৈতিক জীবনে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকারও হতে হয়েছে তাকে।
বরেণ্য রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম ১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আলহাজ আবদুল আজিজ ছিলেন যশোর শহরের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। মা নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। পারিবারিক পরিবেশে বাল্যশিক্ষার মাধ্যমে পড়ালেখায় হাতে খড়ি হয় তার। ১৯৫৩ সালে তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন যশোর জেলা স্কুলে। ১৯৬১ সালে জেলা স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৩ সালে এমএম কলেজ থেকে আইএ, ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ও ১৯৬৯ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন তরিকুল।
পারিবারিক জীবনে তরিকুল ইসলাম ছিলেন দুই ছেলের বাবা। তার স্ত্রী অধ্যাপক নার্গিস বেগম যশোর সরকারি সিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে যান ২০০৫-২০০৬ সালে। নার্গিস ইসলাম ছাত্রজীবনে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি।এরপর চার দশক ধরে স্বামীর সঙ্গে বিএনপির রাজনীতিতে নেপথ্যে ভূমিকা রেখে চলেছেন। বর্তমান তিনি যশোর জেলা বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে আছেন। তরিকুল ইসলামের বড় ছেলে শান্তনু ইসলাম সুমিত ব্যবসার পাশাপাশি দৈনিক লোকসমাজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন। ছোট ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত রাজনীতি করেন। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত অমিত বর্তমানে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন।
১৯৬২ সালের দিকে তরিকুল ইসলাম যশোর এমএম কলেজের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় যশোর শহরের শহীদ মিনারটি ছিল ভাঙাচোরা। তিনি তার বন্ধু ও সহপাঠীরা একটি শহীদ মিনার তৈরি করেছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকারের রোষানলে পড়ে গ্রেফতার হন তরিকুল ইসলাম। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন এমএনএ আহম্মদ আলী সর্দারের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় কিছুদিন কারাভোগ করেন। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জন্য রাজবন্দি হিসেবে যশোর ও রাজশাহীতে কারাভোগ করেন দীর্ঘ নয় মাস। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় গ্রেফতার হন। এরপর দীর্ঘদিন ধরে তিনি রাজশাহী কারাগারে ছিলেন।
পরে কমিউনিস্ট পার্টির নীতি-আদর্শের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে না পেরে বেছে নেন নতুন পথ। ১৯৭০ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ভাসানী আহূত ফারাক্কা লং মার্চেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কথা বলে যেমন কারাভোগ করেছেন, স্বাধীন দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হিসেবেও তাকে জেলে যেতে হয়েছিল।
ভাসানী (ন্যাপ) থেকে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) হয়ে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন বরেণ্য এ রাজনীতিক। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির ৭৬ সদস্যবিশিষ্ট প্রথম আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য তরিকুল ইসলাম। সেই সঙ্গে বিএনপির যশোর জেলা আহ্বায়কের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৮০ সালে জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে পর্যায়ক্রমে তিনি দলের যুগ্ম মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যান ও ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে স্থায়ী কমিটির সদস্য পদে পদোন্নতি পান।
রাজনীতিতে দৃঢ়চেতা এ নেতা স্বৈরাচার এরশাদ আমলে গ্রেফতারের পর তিন মাস অজ্ঞাতস্থানে আটক ছিলেন। পরে তাকে এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। শিকার হন নিষ্ঠুর নির্যাতনের। তিনি রাজনৈতিক জীবনে মিথ্যা মামলা ও কারাভোগের শিকার হয়েছেন বারবার। যশোরে উদীচী হত্যা মামলা, রানার পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল হত্যাকাণ্ডসহ নানা মামলায় আসামির তালিকায় যুক্ত করা হয় তার নাম। ওয়ান ইলেভেনের সময় অন্য সিনিয়র রাজনীতিকদের মতো গ্রেফতার হন তরিকুল ইসলামও। কারাভোগ করেন দীর্ঘ দেড় বছর। মহাজোট সরকারের আমলেও নতুন নতুন মামলার আসামি হয়ে গ্রেফতার ও কারাভোগ করেছেন। বিএনপিতে তার প্রভাব ও গুরুত্বের কারণে মামলা ও গ্রেফতারের বারবার টার্গেট হয়েছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের।
১৯৭৩ সালে যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তরিকুল ইসলাম নাম লেখান জনপ্রতিনিধির খাতায়। পরে ১৯৭৮ সালে যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে যশোর সদর আসন থেকে এমপি নির্বাচিত ও ১৯৮১ সালে সড়ক ও রেলপথ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী চরিত্র হলেও ভোটের রাজনীতিতে তার রয়েছে মিশ্র অভিজ্ঞতা। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। তবে বিএনপি সরকার গঠন করলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান টেকনোক্রাট কোটায়। পরের বছর হন পূর্ণমন্ত্রী।
১৯৯৪ সালের উপ-নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর দায়িত্ব পান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এককালের দুই বন্ধুর মুখোমুখি হন তিনি। বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যাওয়া আলী রেজা রাজু ও জাতীয় পার্টির খালেদুর রহমান টিটোর সঙ্গে লড়ে পরাজিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে আসা খালেদুর রহমান টিটো যশোর সদর আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশা করলেও দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা তরিকুল ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার চিন্তাও করেননি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তারই বাল্যবন্ধু আওয়ামী লীগ প্রার্থী আলী রেজা রাজুকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন তরিকুল ইসলাম। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পর্যায়ক্রমে খাদ্য, তথ্য ও সর্বশেষ বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেন তিনি।
ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ঘুরে আওয়ামী লীগে ঠাঁই নেওয়া এককালের বন্ধু খালেদুর রহমান টিটোর কাছে পরাজিত হন তিনি। বিএনপির পক্ষ থেকে ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। বিএনপি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় প্রার্থী হননি তিনি।
বিএনপির প্রতিটি শাসনামলে যশোরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তরিকুল ইসলাম। এজন্য তিনি যশোর উন্নয়নের কারিগর হিসেবেও খ্যাতি পান।
যশোরের শিক্ষা, সামাজিক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সভাপতি ও উপদেষ্টা হিসেবে দশকের পর দশক দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। রাজনীতির পাশাপাশি যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন তরিকুল ইসলাম।
সম্পাদনা : এএএম/ওকে
সাবেক এই মন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। গত একমাস ধরে তিনি অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
তরিকুল ইসলাম ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে প্রথমে সমাজকল্যাণমন্ত্রী এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে আসার আগে তিনি সহ-সভাপতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
তরিকুল ইসলামের মৃত্যুতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
তরিকুল ইসলামের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম ছিলেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। জীবদ্দশায় তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনৈতিক অঙ্গনকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে আলোকিত করেন তিনি। রাজনৈতিক জীবনে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকারও হতে হয়েছে তাকে।
বরেণ্য রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম ১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আলহাজ আবদুল আজিজ ছিলেন যশোর শহরের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। মা নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। পারিবারিক পরিবেশে বাল্যশিক্ষার মাধ্যমে পড়ালেখায় হাতে খড়ি হয় তার। ১৯৫৩ সালে তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন যশোর জেলা স্কুলে। ১৯৬১ সালে জেলা স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৩ সালে এমএম কলেজ থেকে আইএ, ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ও ১৯৬৯ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন তরিকুল।
পারিবারিক জীবনে তরিকুল ইসলাম ছিলেন দুই ছেলের বাবা। তার স্ত্রী অধ্যাপক নার্গিস বেগম যশোর সরকারি সিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে যান ২০০৫-২০০৬ সালে। নার্গিস ইসলাম ছাত্রজীবনে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি।এরপর চার দশক ধরে স্বামীর সঙ্গে বিএনপির রাজনীতিতে নেপথ্যে ভূমিকা রেখে চলেছেন। বর্তমান তিনি যশোর জেলা বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে আছেন। তরিকুল ইসলামের বড় ছেলে শান্তনু ইসলাম সুমিত ব্যবসার পাশাপাশি দৈনিক লোকসমাজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন। ছোট ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত রাজনীতি করেন। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত অমিত বর্তমানে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন।
১৯৬২ সালের দিকে তরিকুল ইসলাম যশোর এমএম কলেজের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় যশোর শহরের শহীদ মিনারটি ছিল ভাঙাচোরা। তিনি তার বন্ধু ও সহপাঠীরা একটি শহীদ মিনার তৈরি করেছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকারের রোষানলে পড়ে গ্রেফতার হন তরিকুল ইসলাম। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন এমএনএ আহম্মদ আলী সর্দারের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় কিছুদিন কারাভোগ করেন। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জন্য রাজবন্দি হিসেবে যশোর ও রাজশাহীতে কারাভোগ করেন দীর্ঘ নয় মাস। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় গ্রেফতার হন। এরপর দীর্ঘদিন ধরে তিনি রাজশাহী কারাগারে ছিলেন।
পরে কমিউনিস্ট পার্টির নীতি-আদর্শের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে না পেরে বেছে নেন নতুন পথ। ১৯৭০ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ভাসানী আহূত ফারাক্কা লং মার্চেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কথা বলে যেমন কারাভোগ করেছেন, স্বাধীন দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হিসেবেও তাকে জেলে যেতে হয়েছিল।
ভাসানী (ন্যাপ) থেকে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) হয়ে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন বরেণ্য এ রাজনীতিক। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির ৭৬ সদস্যবিশিষ্ট প্রথম আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য তরিকুল ইসলাম। সেই সঙ্গে বিএনপির যশোর জেলা আহ্বায়কের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৮০ সালে জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে পর্যায়ক্রমে তিনি দলের যুগ্ম মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যান ও ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে স্থায়ী কমিটির সদস্য পদে পদোন্নতি পান।
রাজনীতিতে দৃঢ়চেতা এ নেতা স্বৈরাচার এরশাদ আমলে গ্রেফতারের পর তিন মাস অজ্ঞাতস্থানে আটক ছিলেন। পরে তাকে এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। শিকার হন নিষ্ঠুর নির্যাতনের। তিনি রাজনৈতিক জীবনে মিথ্যা মামলা ও কারাভোগের শিকার হয়েছেন বারবার। যশোরে উদীচী হত্যা মামলা, রানার পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল হত্যাকাণ্ডসহ নানা মামলায় আসামির তালিকায় যুক্ত করা হয় তার নাম। ওয়ান ইলেভেনের সময় অন্য সিনিয়র রাজনীতিকদের মতো গ্রেফতার হন তরিকুল ইসলামও। কারাভোগ করেন দীর্ঘ দেড় বছর। মহাজোট সরকারের আমলেও নতুন নতুন মামলার আসামি হয়ে গ্রেফতার ও কারাভোগ করেছেন। বিএনপিতে তার প্রভাব ও গুরুত্বের কারণে মামলা ও গ্রেফতারের বারবার টার্গেট হয়েছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের।
১৯৭৩ সালে যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তরিকুল ইসলাম নাম লেখান জনপ্রতিনিধির খাতায়। পরে ১৯৭৮ সালে যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে যশোর সদর আসন থেকে এমপি নির্বাচিত ও ১৯৮১ সালে সড়ক ও রেলপথ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী চরিত্র হলেও ভোটের রাজনীতিতে তার রয়েছে মিশ্র অভিজ্ঞতা। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। তবে বিএনপি সরকার গঠন করলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান টেকনোক্রাট কোটায়। পরের বছর হন পূর্ণমন্ত্রী।
১৯৯৪ সালের উপ-নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর দায়িত্ব পান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এককালের দুই বন্ধুর মুখোমুখি হন তিনি। বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যাওয়া আলী রেজা রাজু ও জাতীয় পার্টির খালেদুর রহমান টিটোর সঙ্গে লড়ে পরাজিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে আসা খালেদুর রহমান টিটো যশোর সদর আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশা করলেও দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা তরিকুল ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার চিন্তাও করেননি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তারই বাল্যবন্ধু আওয়ামী লীগ প্রার্থী আলী রেজা রাজুকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন তরিকুল ইসলাম। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পর্যায়ক্রমে খাদ্য, তথ্য ও সর্বশেষ বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেন তিনি।
ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ঘুরে আওয়ামী লীগে ঠাঁই নেওয়া এককালের বন্ধু খালেদুর রহমান টিটোর কাছে পরাজিত হন তিনি। বিএনপির পক্ষ থেকে ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। বিএনপি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় প্রার্থী হননি তিনি।
বিএনপির প্রতিটি শাসনামলে যশোরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তরিকুল ইসলাম। এজন্য তিনি যশোর উন্নয়নের কারিগর হিসেবেও খ্যাতি পান।
যশোরের শিক্ষা, সামাজিক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সভাপতি ও উপদেষ্টা হিসেবে দশকের পর দশক দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। রাজনীতির পাশাপাশি যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন তরিকুল ইসলাম।
সম্পাদনা : এএএম/ওকে