২০০৫ সালে বাড়ির পাশেই একটি নার্সারিতে কাজ শুরু করেন মো. ওমর ফারুক। তখন তাঁর বয়স ১২ বছর। দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়ার তেমন সুযোগ হয়নি। টানা আট বছর একাগ্রচিত্তে ওই নার্সারিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। চাকরির একপর্যায়ে মনে মনে নিজে একটা নার্সারি গড়ার স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্ন নিয়েই কাজ শিখতে থাকেন। একপর্যায়ে একটি নার্সারি করার মতো মোটামুটি অভিজ্ঞতা হলে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।
ওমর ফারুক ফেনী পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সুলতানপুর গ্রামের সুরুজ মিয়ার ছেলে। ফেনী মহিলা গার্লস ক্যাডেট কলেজের অদূরে তাঁদের বাড়ি। বাবার বড় ছেলে তিনি। পৈতৃক বসতবাড়ি ছাড়া তেমন কোনো জমিজমা নেই। ২০১৩ সালের শুরুতে এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে একখণ্ড জমি ভাড়া নিয়ে অতি সামান্য পুঁজিতে নিজেই নার্সারি শুরু করেন। নিজে দিনরাত পরিশ্রম শুরু করেন, সঙ্গে ছোট ভাই মো. এয়াছিনকেও কাজে লাগান।
বর্তমানে ফেনী মহিলা ক্যাডেট কলেজের পূর্ব–উত্তর পাশে, আমিনবাজার সড়কের উভয় পাশে তিন খণ্ডের দুই একর (২০০ ডেসিমেল) জমি ভাড়া নিয়ে তাঁদের ‘ফেনী গ্রিন গার্ডেন’ নার্সারি। বর্তমানে তাঁর নার্সারিতে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের দেশি–বিদেশি বিভিন্ন ফল, ফুল, সবজি ও ঔষধি গাছের চারা বিক্রির জন্য মজুত রয়েছে।
ওমর ফারুক জানান, তাঁরা দুই ভাই ছাড়াও বর্তমানে তাঁদের নার্সারিতে আটজন প্রশিক্ষিত কর্মচারী নিয়মিত কাজ করেন।
নার্সারি প্রতিষ্ঠার ছয় বছরের মাথায় ২০১৯ সালে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও সামাজিক বন বিভাগের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত বৃক্ষমেলায় একজন সফল ও সেরা উদ্যোক্তা হিসেবে প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন। তার আগে ২০১৮ ও ২০১৭ সালেও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও সামাজিক বন বিভাগের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত বৃক্ষমেলায় একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তৃতীয় পুরস্কার লাভ করেন।
ওমর ফারুক জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে ফেনী পৌরসভার আওতাধীন জলবায়ু প্রকল্প তহবিলের অর্থায়নে শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রাজাঝির দীঘি ও মহিপালে সরকারি সার্কিট হাউসের সামনের বিজয় সিংহ দীঘিপাড়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি প্রকল্পে ১৫ লাখ টাকার বিভিন্ন প্রজাতির চারা কলম সরবরাহ করেছেন।
চলতি বছর ২০ হাজার রেড লেডি হাইব্রিড পেঁপের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। প্রতিটি ৩০ টাকা করে এরই মধ্যে ১০ হাজার চারা বিক্রি করা হয়েছে। উৎপাদিত বাকি চারা নার্সারিতে মজুত রাখা আছে। বিভিন্ন প্রজাতির ৫০ হাজার ফুলের চারা (প্রতিটি গড়ে ২৫ টাকা), দেশি ও বিদেশি ফলের রকমারি ২০ হাজার চারা ও কলম, স্থানীয় জাতের ৫ হাজার চারা উৎপাদন ও মজুত রাখা হয়েছে। হাইব্রিড লাউয়ের চারা এরই মধ্যে বিক্রি করা শেষ হয়ে গেছে।
ওমর ফারুক জানান, গত আট বছরের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা নার্সারির দুই একর জমির সবটাই প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ভাড়া (ইজারা) নিয়ে করেছেন। আয়ের অর্থে শুধু পরিবারের জন্য একটি একতলা বসতঘর নির্মাণ করেছেন। নার্সারির মালামাল পরিবহনের জন্য একটি পিকআপ ভ্যান কিনেছেন। বর্তমানে তাঁর নার্সারিতে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের নানা জাতের চারা ও কলম রয়েছে। তাঁর নার্সারিতে হাইব্রিড বেগুনের চারা, হাইব্রিড মরিচের চারা, গাঁদা, নয়নতারা, পিটুনিয়া, ডালিয়া, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন বিদেশি ফুলের চারা, কয়েক ধরনের লেবুর চারা কলম, বিভিন্ন জাতের পেয়ারা, বিভিন্ন জাতের আমের মধ্যে সূর্য ডিম, চিয়াংমাই, ব্রুনাই কিং, কাটিমন, নামডটমাই, কিউজয়াই, বারি-১১, ৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, আলফাউসু, রেড পালমার, গৌড়মতিসহ, কাঁঠাল, আমড়া, লিচু, ডুরিয়ান, রাম্বুটান, ড্রাগন, জলপাই, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম, জাবাটিকাবা, অ্যাভোকাডো, পার্সিমন, তিনফল, জয়তুন, অলিভ অয়েল, আঁশ ফল, ট্যাংক ফল, খুরমা খেজুর, ব্ল্যাকবেরি, মালবেরি, আলু বোখারা, আপেল, নাশপাতি, স্ট্রবেরিসহ নানা জাতের, নানা প্রজাতির চারা কলম উৎপাদন ও বিক্রি করা হয়। ফারুকের নার্সারি দেখে এরই মধ্যে আশপাশের আরও অনেকে ছোট ছোট নার্সারি গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছেন।
ফেনী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম জানান, তিনি মাত্র মাসখানেক আগে ফেনীতে যোগদান করেছেন। এ ধরনের ব্যক্তি উদ্যোক্তার কাজের প্রশংসা করে তিনি বলেন, দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরিতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সব সময় সহযোগিতা করবে।
ফেনী ট্রিবিউন/এএএম/এপি