আজ

  • শুক্রবার
  • ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চাকরি হারানোর আতঙ্কে গণমাধ্যমের কর্মীরা

  • অনলাইন ডেস্ক
  • গভীর সঙ্কটের মুখে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। সেই প্রেক্ষাপটে চাকরি হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। ইতিমধ্যে অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তাদের ই একজন তনুশ্রী রায়। তিনি গত ৬ মাস আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদ বিভাগ থেকে চাকরি চ্যুত হন। এখনও কোথাও তার চাকরি হয়নি।

    ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সংবাদপত্র বা অনলাইন-এসব বিভিন্ন গণমাধ্যমে চাকরি খুঁজতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক সঙ্কটের কথা তাকে শুনতে হচ্ছে।

    তনুশ্রী রায় যে টেলিভিশনে কাজ করতেন, সেই বেসরকারি চ্যানেলের সংবাদ বিভাগেই বেশি ছাঁটাই করা হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে তিনিসহ ৩২ জনকে বিদায় করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

    তনুশ্রী রায় জানান, টিভি চ্যানেলটির পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সমস্যার জানিয়ে তাদেরকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল এবং সেটা করতে তারা বাধ্য হয়েছেন। কারণ, চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নিজেদের ঘাড়ে দায় রাখেননি। আরেকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের বার্তা বিভাগই বন্ধ করে দিয়েছে কয়েকমাস আগে। বেসরকারি রেডিওগুলোরও একই অবস্থা।

    বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদসহ বিভিন্ন বিভাগে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। গত কয়েক মাসে বিভিন্ন সংবাদপত্রেও অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। বেশিরভাগ বেসরকারি টেলিভিশনে নিয়মিত বেতনও হচ্ছে না। নিয়মিত বেতন না পাওয়া ও চাকরি হারানোর ভয়সহ চরম সঙ্কটে রয়েছে ওইসব চ্যানেলে কর্মরত সংবাদকর্মীরা। তারা বলছেন, শুধু সাংবাদিকরাই নন, গণমাধ্যমে কর্মরত সবার একই অবস্থা।

    ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সঙ্কটের কারণ

    বাংলাদেশে গতদুই দশকে গণমাধ্যমে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আর এই পরিবর্তনের প্রায় সবটাই এসেছে ইলেকট্রিক সংবাদ মাধ্যমে। দেশে বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও’র সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এখন ৩০টি বেসরকারি টেলিভিশন চালু রয়েছে। আরও ১৫টি সম্প্রচারে আসার অপেক্ষায় আছে। ২৬টি বেসরকারি রেডিও চালু রয়েছে। প্রত্যেক জেলায় কমিউনিটি রেডিও তো আছেই।

    কিন্তু টেলিভিশন রেডিও’র লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়কেই মূল বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন অভিযোগ বেশ জোরালো।

    বাংলাভিশনের বার্তা বিভাগের প্রধান মোস্তফা ফিরোজ বলেছেন, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিকদের রাজনৈতিক পরিচয় এবং সরকারি চাপের কারণে এই মাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। ফলে মানুষ একেবারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বলা যায়।

    তিনি আরও বলেছেন, সরকারের চাপ দেখা যায় না। কিন্তু সেটা দৈত্য বা ভূতের মতো এই মাধ্যমের সবকিছুতেই খড়গ হস্ত চালাচ্ছে। সেজন্য বেসরকারি সব টেলিভিশনের নিউজ, টকশো বা অন্য অনুষ্ঠান – সব একই রকম। কোন টেলিভিশনকে আলাদা করে তার বৈশিষ্ট্য বের করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষ এসব চ্যানেল থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’

    মোস্তফা ফিরোজ আরো বলেন, ভালো বা ভিন্ন কিছু না পেয়ে মানুষ এখন ভারতের টেলিভিশনগুলোর প্রতি ঝুঁকেছে এবং ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যম এখানে জনপ্রিয় হয়েছে। ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা ভারতীয় চ্যানেল বা সামাজিক মাধ্যমে যাচ্ছে। আর এ কারণে বাংলাদেশের মিডিয়া অর্থ সংকটে পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।

    আরেকটি বেসরকারি টেলিভিশনের ঊর্ধ্বতন একজন নারী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, মালিকদের রাজনৈতিক পরিচয়ই যেহেতু মূল বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর সেটাই সঙ্কটের একটা বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন।

    এ ব্যাপারে ওই টিভি কর্মকর্তার যুক্তি হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিচয়ে লাইসেন্স নেয়ার পর সেই ব্যক্তি অন্য ব্যবসার ঢাল হিসেবে তার মিডিয়া চালু করছেন। কিন্তু তাতে বড় বিনিয়োগ না করে এখন কোনোভাবে একটা প্রতিষ্ঠান চালু রাখছেন।

    মালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও এখনকার সঙ্কটকে স্বীকার করা হয়েছে। তবে এজন্য তারা বিজ্ঞাপনের ছোট বাজারকে দায়ী করেছেন।

    ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা এবং সরকারের চাপের কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে ইলেকট্রনিক মিডিয়া মানুষের আস্থা হারিয়েছে। এছাড়া অর্থ সংকটসহ সব মিলিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সঙ্কট দিনে দিনে বেশি গভীর হচ্ছে বলে এর সাথে জড়িতরা বলছেন।

    সরকার এসব বক্তব্য মানতে রাজি নয়। সরকারের পক্ষ থেকে টেলিভিশন রেডিও’র সংখ্যা বৃদ্ধিকেই ইতিবাচক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।

    প্রিন্ট মিডিয়া কি টিকে থাকতে পারবে?

    একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক বলেছেন, নানামুখী চাপের কাছে এখন অনেক ক্ষেত্রেই সমঝোতা করে চলতে হচ্ছে। ফলে সংবাদপত্রের প্রতিও মানুষের বিশ্বাস কমছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সম্পাদক তাদের মাধ্যমে সংকটের বড় কারণ হিসেবে দেখেন সরকারের চাপকে।

    সংবাদপত্রের সাথে জড়িত ঊর্ধ্বতন এবং এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের রাজনৈতিক পরিচয়ও একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বলে অভিযোগ রয়েছে। সংবাদকর্মীদের অনেকের বক্তব্য হচ্ছে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভিড়ের মাঝেও সংবাদপত্র কিছু আস্থা নিয়ে টিকে ছিল। এখন সামাজিক মাধ্যমের কারণেও সংবাদপত্র শিল্প বড় সংকটের মুখে পড়েছে।

    কোন ঘটনা ঘটলে মুহূর্তেই মানুষ এখন ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে তা পাচ্ছে। ফলে ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করে পরদিন গিয়ে সেই সংবাদ দেখার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকেও সংবাদমাধ্যমের সঙ্কটের একটা অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়।

    ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে কয়টি পত্রিকার কর্মীরা ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন পান-সেই প্রশ্ন অনেকে তোলেন। সেই সংখ্যা নগণ্যই বলা হয়।

    তবে এবার কয়েকমাস আগেও প্রথম আলো’র মতো অর্থনৈতিকভাবে ভালো অবস্থান থাকা পত্রিকা থেকেও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শাখার বেশ কয়েকজনকে ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। অনেক পত্রিকা থেকেই লোকবল ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। সংবাদপত্রেও একটা চরম সংকট দৃশ্যমান হচ্ছে।

    অনলাইনের বিকাশের যুগে এই মাধ্যমও সঙ্কটে পড়েছে বাংলাদেশের অনলাইনের সঠিক কোনো সংখ্যা নেই। প্রথমবারের মতো এগুলোর নিবন্ধনের জন্য সরকার আবেদনপত্র নিয়েছে। তাতে আড়াই হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে বলে জানা গেছে।

    এই মাধ্যমের সাথে জড়িতদের অনেকে বলেছেন, হাতেগোনা কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল মানুষের আস্থা পেয়েছে। ফলে তারা ভাল বিজ্ঞাপন পেয়ে লাভবানও হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ অনলাইনই এখনও সেভাবে আস্থা অর্জন করতে পারেনি এবং সেটাই এই মাধ্যমের সঙ্কটের একটা বড় কারণ। ফলে বেশিরভাগ অনলাইন পোর্টাল অর্থ সংকটে রয়েছে। এই মাধ্যমেও বড় কয়েকটি অনলাইন থেকে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলছিলেন, বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের বাজার খুবই ছোট। আর গণমাধ্যম বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়ছে-এই দু’টি বিষয়ই সত্য। তবে তিনি মনে করেন, সামাজিক মাধ্যমের কারণে সারাবিশ্বেই আনুষ্ঠানিক গণমাধ্যমে একটা অস্থিরতা চলছে।

    সূত্র: বিবিসি বাংলা


    error: Content is protected !! please contact me 01718066090