১৯৭৭ সাল। খুশিপুর প্রাইমারী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের গ্রামেই স্কুল। বাড়ী থেকে ৫ মিনিট হাটলেই স্কুলে পৌঁছা যায়।
স্কুলে তিন জন শিক্ষক। হেড মাস্টার জনাব আব্দুর রশীদ। খশিপুর গ্রামের গ্রামের দক্ষিন পাশ দিয়ে প্রবাহিত খালটির ওপারে হীরাপুর গ্রামে উনার বাড়ী। খালের উপর একটি সাঁকো ছিল। তিনি প্রতিদিন ঐ খাল পার হয়ে আসতেন। উনাকে যদি কোন দিন স্কুল ছুটি দেয়ার অনুরোধ করতাম উনি বলতেন- ‘ছুটি’ আজ আসার সময় সাঁকো পার হতে গিয়ে খালে পড়ে গেছে। তাই ছুটি দিতে পারছিনা। উনি একটি ছড়া আমাদেরকে সব সময় শুনাতেন- তেলাপোকা পাখি নয়, ডানা আছে কিন্তু,
খুশিপুর স্কুলের একজনও ছাত্র নয়, সবগুলো জন্তু।
স্কুলে আর একজন শিক্ষক মৌলভী সুলতান আহাম্মদ। তিনি ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। দরাজ গলায় কথা বলতেন। লুঙ্গি ও লম্বা পাঞ্জাবী পরে স্কুলে আসতেন। উনার গ্রাম দক্ষিন নেয়াজপুর। পরীক্ষার সময় উনি প্রশ্ন সাথে করে নিয়ে আসতেন। উনি স্কুলে এলেই পরীক্ষা শুরু হতো।
মুন্সী সুজাত আলী ছিলেন অপর শিক্ষক। তিনি খুশিপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। সম্পর্কে দাদা হতেন বলে উনাকে স্কুলেও দাদা বলেই ডাকতাম। তিনি ছিলেন একজন চৌকষ শিক্ষক। বাংলা, ইংরেজী, অংক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ও পৌরনীতি-সকল বিষয়েই উনার কমবেশি দখল ছিল। তিন শিক্ষকই বয়স্ক মানুষ ছিলেন। আমরা উনাদেরকে হুজুর বলে সম্বোধন করতাম।
স্কুল ঘরটি পূর্ব দিকে মুখ করা উত্তর দক্ষিনে লম্বা একটি একতলা দালান। কোন আমলে এর প্লাস্টারিং শেষ হলেও রং করা হয়নি। ফ্লোরটি করা হলে ও ফিনিশিং দেয়া হয়নি। তাই এটি ছিল মাটির প্রলেপযুক্ত একটি ফ্লোর। সর্ব দক্ষিণের একটি ছোট কক্ষ স্কুলের অফিস। উত্তর পাশে একটি বড় কক্ষ। এতে কোন পার্টিশান ছিলনা। সকাল ১০টা থেকে ১২ টা শিশু শ্রেণি, প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস হত। ১২ থেকে ৪টা তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হত। এক ক্লাসের ছাত্র শিক্ষক অন্য ক্লাসের ছাত্র শিক্ষককে দেখতে পেতেন। স্কুলে কোন হাই বেঞ্চ ছিলনা। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি একটি লো বেঞ্চে বসার সুযোগ পেতো। শিশু শ্রেণির জন্য কোন বেঞ্চ হিলনা। এ শ্রেণিটি ফ্লোরে বসেই ক্লাস করতো। নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এক সময় স্কুলের ছাদটি ভেঙ্গে ফেলে টিনের শেড করা হয়।
স্কুলের সামনে ছোট একটি মাঠ। মাঠের শেষ প্রান্তে একটু নীচ জায়গা। বর্ষাকালে পানি জমে ডোবার মত দেখাত। তার পাশে একটি গোরস্থান। গোরস্থানের একটি মাত্র কবর ছিল পাকা। এর দিকে আমরা কখনো আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতাম না। কখনো ভুলে করে ফেললে তিনবার আঙ্গুলে কামড় দিতাম।
পঞ্চম শ্রেণিতে কয়েক মাস ক্লাস হয়ে যাবার পর আমাদের সাথে ভর্তি হল এনায়েত। তার বাড়ী দক্ষিণ খুশিপুরে। এনায়েত কয়েকবছর গজারিয়া মাদ্রাসায় হিফয পড়ে আমাদের সাথে ভর্তি হয়েছে। বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক বড় ছিল। বয়স ও শারিরিক কাঠামো আমাদের তুলনায় বড় হওয়াতে ওনেক বিষয়েই আমরা এনায়েতকে আ্মাদের নেতা মেনে নিলাম। এনায়তের উপর আমাদের গভীর আস্থা।
৭৭ সালে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ফ্রি বিতরনের জন্য গুড়া দুধ এসেছে। স্কুল সে দুধ ড্রামের মধ্যে পানিতে মিশিয়ে বিতরনের সিদ্ধান্ত নিল। নির্দিষ্ট দিনে ছাত্রছাত্রীরা বাড়ী থেকে জগ, মগ নিয়ে আসবে এবং তরল দুধ নিয়ে যাবে। বিষয়টি আমাদের পছন্দ হল না। এর আগেও দু’একবার এ ধরনের বণ্টন দেখেছি। যারা পানিতে মিশানো ও বন্টনের কাজ করে তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছনা সম্পর্কে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। আর বাড়ী থেকে জগ নিয়ে এসে স্কুল থেকে তরল দুধ নিয়ে যেতে ছোট মানুষ হলে ও আমাদের প্রেস্টিজে লাগতেছিল।
আমাদের ইচ্ছা- দুধ পাউডার হিসেবেই বিতরন করা হোক। এনায়েতের নেতৃত্বে আমরা ৫ম শ্রেণি বৈঠক করলাম। বৈঠকে উপস্থিত যাদের নাম মনে আছে তারা হচ্ছে- নূর মোহাম্মদ বাচা মিয়া, আবুল কালাম আজাদ মিন্টু, আব্দুল ওয়াদুদ মিয়া, মোহাম্মাদ ইব্রাহীম, কবির আহাম্মদ। এনায়েত দায়িত্ব নিল। হেড মাস্টারকে বলে সে তরল বন্টনের উদ্যোগ ঠেকিয়ে দেবে। আমাদেরও বিশ্বাস, এনায়েত পারবে।
নির্দিষ্ট দিনে স্কুলে গেলাম। দেখলাম, স্কুলের দক্ষিণ পশ্চিম কোণের টিঊব ওয়েলের পাশে বড় ড্রামে পাউডারে পানি মিশিয়ে দুধ তরল করা হচ্ছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও অনেক অভিভাবকও জগ, হাড়ি ও বিভিন্ন প্রকার পাত্রে দুধ নিয়ে বাড়ী চলে যাচ্ছে। এনায়েত সহ আমরা কয়েকজন চেয়ে চেয়ে দেখলাম। আমরা পাত্র ও আনিনি দুধ ও নিইনি। প্রতিবাদ করার সাহস আমাদের ছিলনা। আমাদের নেতা এনায়েতের ও না।
লেখক:
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন
চেয়ারম্যান
হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।